শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

খাদ্যপণ্য সংকটে বিশ্ব

খাদ্যপণ্য সংকটে বিশ্ব

আগের যুদ্ধগুলোতে শুধু যুদ্ধরত দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখা গেলেও এবারের যুদ্ধ প্রভাবিত করছে সারাবিশ্বকে। রুটির ঝুড়ি খ্যাত ইউক্রেন-রাশিয়ার খাদ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বিশ্ব। সবদেশেই খাদ্যের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধির মধ্যে এর দায় কার সেটা নিয়েও শুরু হয়েছে বিতর্ক। একের পর নিষেধাজ্ঞা আর জ্বালানি অনিশ্চয়তা অস্থিরতা বাড়াচ্ছে বিশ্বে। বিশ্বজুড়ে খাদ্য পরিস্থিতির অবনতির জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া একে অপরকে দায়ী করছে। গত বৃহস্পতিবার দেশ দুটি এমন প্রতিক্রিয়া জানায়।

সংকট মোকাবিলায় কৃষ্ণ সাগর বন্দরে আটকে থাকা ইউক্রেনীয় শস্য রপ্তানির অনুমতি দেওয়ার জন্য রাশিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্রের আয়োজিত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, কৃষ্ণ সাগরের বন্দরগুলো অবরুদ্ধ করা বন্ধ করুন। ইউক্রেনের বাইরে খাদ্য বহনকারী জাহাজ, ট্রেন ও ট্রাকগুলোর অবাধ প্রবাহের অনুমতি দিন।

এদিকে, জাতিসংঘ সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে সামনের মাসগুলোতে বৈশ্বিক খাদ্য সংকট তৈরি হতে পারে। সংস্থাটির মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, এই যুদ্ধের কারণে দাম বৃদ্ধি পাওয়াতে দরিদ্র দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে। তার আশংকা, শেষ পর্যন্ত ইউক্রেন থেকে রপ্তানি স্বাভাবিক না হলে বিশ্ব দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হতে পারে।

জাতিসংঘের হিসেবে গত বছরের তুলনায় এ বছর খাদ্যপণ্যের দাম ইতোমধ্যেই সারাবিশ্বে অন্তত ৩০ শতাংশ বেড়েছে। গুতেরেস সতর্ক করে বলেন, খাদ্য সংকটের কারণে কোটি কোটি মানুষ অপুষ্টি, ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের মুখে পড়তে পারে।

জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, রাশিয়া, ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে যাতে করে খাদ্য রপ্তানি স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা যায়। তিনি এমন সময় এমন মন্তব্য করলেন যখন বিশ্ব ব্যাংক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা মোকাবেলায় অতিরিক্ত ১২ বিলিয়ন ডলারের অর্থ সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  খুঁটি না সরিয়ে সড়ক সম্প্রসারণ

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের সমালোচনাকারী দেশগুলোতে খাদ্য ও সার রপ্তানি বন্ধ রাখার হুমকি দেওয়ার ব্যাপারেও হুঁশিয়ারি দেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, লাখ লাখ ইউক্রেনীয় এবং বিশ্বজুড়ে আরও বহু মানুষের জন্য খাদ্য সরবরাহ আক্ষরিক অর্থেই রুশ সামরিক বাহিনীর হাতে জিম্মি হয়ে আছে।

এদিকে, জাতিসংঘে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া যুক্তরাষ্ট্রের এ অভিযোগের পাল্টা জবাব দিয়ে বলেছেন যে বিশ্বের সব দুর্দশার জন্য তার দেশকে দায়ী করা হচ্ছে। তার মতে পশ্চিমা বাজারের জল্পনা-কল্পনা থেকে উদ্ভূত মূল্যস্ফীতিজনিত কারণে দীর্ঘদিন ধরে খাদ্য সংকটে ভুগছে বিশ্ব। কৃষ্ণ সাগরের উপকূলে মাইন স্থাপন করে ইউক্রেন নিজেরাই বন্দর অবরুদ্ধ করে রেখেছে বলেও পাল্টা অভিযোগ করেন তিনি। ইউক্রেন বন্দরে অবরুদ্ধ কয়েক ডজন বিদেশি মালবাহী জাহাজকে মুক্ত করতে শিপিং সংস্থাগুলোকেও সহযোগিতা করতে চায় না ইউক্রেন এমন অভিযোগও করেন এই কর্মকর্তা।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার নিন্দা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, বিশ্বজুড়ে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাকে আরও খারাপ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে গেছে এটি। পাল্টা জবাবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেন এই নিষেধাজ্ঞা রাশিয়াকে খাদ্য ও সার রপ্তানি করতে বাধা দিচ্ছে না।

অন্যদিকে, রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছেন, তার দেশের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার বৈশ্বিক পরিণতি বিস্তৃত হবে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র-কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থাও ভেঙে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। কারণ বর্তমানে যা ঘটছে তার সবকিছুই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পশ্চিমা ধারণার দুর্বলতাকে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরবে বলেও মনে করেন তিনি। সংকটের পাশপাশি মুদ্রস্ফিতিতে ৪০ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছে যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রও। সামনে খাদ্যেও দাম আরো বেড়ে গেলে সামাজিক স্থিতিশীলতা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দেয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ  করোনা নিয়ে স্বাস্থ্যের ডিজির বক্তব্য কাণ্ডজ্ঞানহীন : কাদের

এদিকে, খাদ্য সংকটের পাশাপাশি চরম আর্থিক সংকটে পড়তে যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। জ্বালানি তেল-গ্যাসের বাড়তি দাম ভোগান্তিতে ঠেলে দিচ্ছে অনেক দেশকে। শ্রীলঙ্কার পতনের পর বিভিন্ন দেশে সতর্কতা জারি করা হচ্ছে। ব্যয় সংকোচন করতে গিয়ে বিদেশ সফর ও আমদানির রাশ টেনে ধরা হচ্ছে। ৩৮টি অপ্রয়োজনীয় বিলাসবহুল পণ্যের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে পাকিস্তান। বিদেশ সফর বাতিল করে বিলাস পণ্য আমদানি কমাচ্ছে বাংলাদেশ। নেপাল-ভারতও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে।

উল্লেখ্য ইউক্রেন এবং রাশিয়া বিশ্বব্যাপী খাদ্যের ১০ ভাগের এক ভাগ সরবরাহ করে। তারা বিশ্বের গম রপ্তানির ৩০ শতাংশের পাশাপাশি সূর্যমুখী তেলের ৬০ শতাংশ উৎপাদন করে। কমপক্ষে ২৬টি দেশ তাদের অর্ধেকেরও বেশি খাদ্যশস্যের জন্য রাশিয়া এবং ইউক্রেনের ওপর নির্ভরশীল। যুদ্ধের আগে ইউক্রেন ৪৫ মিলিয়ন টন খাদ্য শস্য প্রতি মাসে রপ্তানি করতো। কিন্তু রাশিয়ার আগ্রাসনের পর সব রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে এবং জাতিসংঘের হিসেবে ২০ মিলিয়ন টন ভুট্টা এখনো সেখানে আটকা পড়ে আছে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন