শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঘুরে দাঁড়াবে পর্যটন

ঘুরে দাঁড়াবে পর্যটন

বিশ্বখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার সেই শ্যামল সবুজ বাংলার ছায়া সুনিবিড় প্রান্তর আজ নতুন রূপে হাজির হয়েছে বিশ্বের সামনে। বিশ্বের দীর্ঘতম সাগর সৈকত নিয়ে অপরূপ বাংলাদেশের সবকিছুই টানে বিদেশিদের। সেজন্য পর্যটনের নান্দনিক বাংলাদেশ এখনও দেশিবিদেশি পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্য হয়ে উঠেছে। একইসঙ্গে জাতীয় সম্প্রসারণশীল অর্থনীতিকে আরো বেগ দিয়েছে, দিচ্ছে। আগের চেয়ে আর্থিক সক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় এখন দেশে ভ্রমণ হিসেবে বিনোদন সবচেয়ে আকর্ষণীয় হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছরে অনেকটাই সংঙ্কুচিত হয়েছে দেশের অপার সম্ভাবনার পর্যটনখাত।

হিসাব মতে, অভ্যন্তরীণ বিপুল সংখ্যক ভ্রমণ পিপাসুই বাঁচিয়ে রেখেছেন দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) অবদান রাখা ১৫টি খাতের অন্যতম এ খাতটিকে। এবারের স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তাই ঘুরে দাড়াঁবার স্বপ্ন দেখছে এ খাতের সঙ্গে জড়িত কয়েক লাখ উদ্যোক্তা। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ২ বা ৩ মে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদুল ফিতর উদযাপন হবে।

এবার ঈদে ৫ মে ছুটি নিলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা টানা ৯ দিনের ছুটি পাবেন। একই পরিস্থিতি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও। ফলে ঈদকেন্দ্রিক লম্বা ছুটির সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে প্রমোদভ্রমণে সময় কাটাবেন। বিশেষ করে নগরবাসীর একাংশ যেমন গ্রামের বাড়িতে যাবেন, তেমনি আরেকটি অংশ যাবেন দেশের বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় ঘুরতে।

এরইমধ্যে পর্যটকদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত হচ্ছে দেশের প্রতিটি পর্যটনকেন্দ্র। করোনা বিধিনিষেধ না থাকায় অনেকে এবার ঈদের ছুটিতে দেশের বাইরে ভ্রমণের পরিকল্পনাও করছেন। ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর কাটছে ব্যস্ত সময়। এরইমধ্যে কক্সবাজার, কুয়াকাটা, সিলেট, বান্দরবান, শ্রীমঙ্গল, সুন্দরবন, খাগড়াছড়িসহ বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রের হোটেল-মোটেলের বেশিরভাগই বুকিং হয়ে গেছে।

আসন্ন ঈদুল ফিতরে দেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে ভ্রমণকরীদের সংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জাবেদ আহমেদ দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, মোটামুটি ১০ লাখ মানুষ দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন গন্তব্যে যাবেন। দেশের বাইরে যেতে পারেন আরো ৫ লাখ মানুষ। তাছাড়া দেশেও একটি বড় সংখ্যক বিদেশে পর্যটক আসবেন বলে জানান তিনি। তার বাইরে বিভিন্ন প্রবাসী বাংলাদেশিরাও দেশে আসবেন। তারা বিভিন্ন গন্তব্যে যাবেন। পয়সা খরচ করবেন।

আরও পড়ুনঃ  দেশের ভোজ্যতেলের বাজারে হঠাৎ অস্থিরতা

এদিকে, এবারের ঈদুল ফিতরের টানা ছুটি এবং সামনের কোরবানির ঈদের ছুটিতে পর্যটনখাত ঘুড়ে দাড়াঁতে বড় ধরণের সাহায্য করবে বলেও মন্তব্য করেন জাবেদ আহমেদ। এবার যথেষ্ট ছুটি পাওয়া গেছে এবং আগামী ঈদেও ছুটি পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন তিনি। হোটেল-মোটেল মোটামুটি এখন ঈদের ছুটির বুকিং হয়ে গেছে বলে জানান তিনি।

আসন্ন ঈদুল ফিতরের ছুটিতে কক্সবাজারে লাখো পর্যটক ভ্রমণের আশা করছেন খাতটির ব্যবসায়ীরা। ইতোমধ্যে হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টগুলোতে ৬০ শতাংশ কক্ষের আগাম বুকিং হয়ে গেছে। তাদের আশা ঈদের পরের দুই-তিন দিন কোনো হোটেলই জায়গা খালি থাকবে না। তাই পর্যটকদের বরণ করতে নগরীর পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল-গেস্ট হাউজ সব ধরনের প্রস্তুতি সেরে রেখেছে।

এদিকে রাঙামাটিতেও হোটেল-মোটেলের ৭০ শতাংশ কক্ষ আগাম বুকিং হয়ে গেছে। পর্যটকদের বরণের প্রস্তুতিও সেরেছেন হোটেল ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি ট্যুরিস্ট বোট ও রেস্টুরেন্টগুলোর রঙিন করে তোলা হয়েছে। রাঙামাটিতে বেড়াতে আসা পর্যটকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ কাপ্তাই হ্রদে নৌবিহার। কেউবা দূরের শুভলংয়ের জলপ্রপাতে স্বস্তি খোঁজেন। কেউবা হ্রদের নীল জলে ডুব দিয়ে বা হ্রদের পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো পাহাড়ের সৌন্দর্যে খোঁজেন তৃপ্তি। আর এ কাজে নিয়োজিত জেলার প্রায় ৫০০ ইঞ্জিনচালিত বোট। সবচেয়ে বেশি বোট মেলে বিখ্যাত ঝুলন্ত সেতুর পাড়ের ঘাটেই।

পর্যটকদের বরণ করতে কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে সাগরকন্যাখ্যাত সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পর্যটননগরী কুয়াকাটা। ঈদের দিন থেকে প্রায় লক্ষাধিক পর্যটকের আগমনে মুখরিত হয়ে উঠবে সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটা। এমন প্রত্যাশাকে সামনে রেখে আলোকসজ্জাসহ রঙের আস্তরণ আর নতুন কারুকার্যে সজ্জিত হয়েছে অধিকাংশ হোটেল-মোটেল-কটেজ ও বাজার। সৈকতে বসেছে খাবারসহ নানা পণ্যের ভ্রাম্যমাণ দোকান।

ঈদুল ফিতরের ছুটিকে কেন্দ্র করে পর্যটক বরণে প্রস্তুত চায়ের রাজ্য মৌলভীবাজার জেলার পর্যটনকেন্দ্রগুলোও। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় চেনারূপে ফিরবে জেলার ট্যুরিস্ট স্পটগুলো; এমনটাই প্রত্যাশা পর্যটনসংশ্লিষ্টদের। ঈদের দিন ও এর পরের কয়েক দিন প্রচুর পর্যটকের আগমন ঘটবে এ জেলায়। পর্যটকদের সব ধরনের নিরাপত্তা দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও প্রস্তুতি নিয়েছেন। কমলগঞ্জের সারি সারি চা বাগান, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবপুর লেক, শ্রীমঙ্গলের বদ্ধভূমি একাত্তর, চা গবেষণা কেন্দ্র, বাইক্কা বিল ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন পর্যটকরা।

আরও পড়ুনঃ  ডুবে যাওয়া ফে‌রি উদ্ধা‌র অভিযান আপাতত বন্ধ

ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান আনন্দবাজারকে বলেন, প্রায় ১০ লাখ লোকের মুভমেন্ট হবে এবার। তবে সবাই পর্যটক নন। অনেকে ঈদ করতে বাড়িতে যাবেন। ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, পর্যটন এমন একটা শিল্প, যার ক্ষতি রাতারাতি পুষিয়ে নেয়া যায় না। তবে এই সিজনের মাধ্যমে গতি সঞ্চার হচ্ছে। এ শিল্পের সব স্টেকহোল্ডার প্রাণের সঞ্চার পাচ্ছেন। তাছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলে পর্যটনের বিকাশের ফলে অর্থনীতির বহুমাত্রিক ব্যবহার হচ্ছে।

করোনা মহামারি বিপদগ্রস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে শিখিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন ট্যুর অপারেটর নেতা রাফেউজ্জামান। দেশীয় পর্যটনের সাফল্যের চূড়ায় যেতে হলে পর্যটন কেন্দ্রগুলোর ধারণক্ষমতার আলোকে ভ্রমণ করতে হবে বলেও মনে করেন তিনি। শুধুমাত্র কক্সবাজার, কুয়াকাটা, সিলেট বা সেন্টমার্টিন, সুন্দরবনে না গিয়ে অন্যান্য সুন্দর জায়গাগুলোতেও ভ্রমণ করার আহ্বান জানান তিনি। মানুষ যেন দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেড়ায় এবং বিদেশে কম যেন যান সেই আশাবাদ ব্যক্ত করেন এ পর্যটন ব্যবসায়ী।  

বিগত সময়ের তুলনায় এবার পর্যটকদের ঢল সামলাতে বিশেষভাবে নিরাপত্তা জোরদার করেছে টুরিস্ট পুলিশ। এ বিষয়ে টুরিস্ট পুলিশের আইন ও গণমাধ্যম শাখার এসপি মো. ইব্রাহিম খলিল বলেন, কোনো বিধিনিষেধ না থাকায় এবার বিপুল সংখ্যক পর্যটকদের নিরাপত্তায় দেশের ১১টি জোনে প্রায় ১২শ টুরিস্ট পুলিশ সদস্য নিয়োজিত থাকবে। এসময় সব টুরিস্ট পুলিশ সদস্যের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। পোশাকের পাশাপাশি সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারি থাকবে। তাছাড়া কন্ট্রোল রুম থেকে সার্বক্ষণিক হটলাইন নাম্বারে সেবা দেয়া হবে। কক্সবাজারের সাম্প্রতিক দূর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে এমন ঘটনা ঘটনা ঘটার আগেই প্রতিরোদে জোর দেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে ঈদ উদযাপনের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষই তাদের গ্রামের বাড়িকে বেছে নেয় বাবা-মা কিংবা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য। তবে একই সঙ্গে অনেকই সেদিকে না গিয়ে দেশের বাইরে যেতে পছন্দ করেন। বাংলাদেশ থেকে অনেক পর্যটক এবারের ঈদে দুবাই, মালদ্বীপ এবং থাইল্যান্ডে যাচ্ছেন। এবারের বিশেষত্ব হচ্ছে টানা নয়দিন ছুটি কাটানো যাবে। তাছাড়া ঈদের সময় বোনাস বাবদ অনেকের কাছেই বাড়তি কিছু অর্থ জমা হয়। সে টাকাও পর্যটন খাতে ব্যয় করতে পছন্দ করেন অনেকে।

আরও পড়ুনঃ  ১২ নভেম্বর 'উপকূল দিবস' হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি

এক্ষেত্রে উচ্চবিত্তদের পছন্দ থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, মিসর, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও অন্যান্য দেশ। ঈদের ছুটিতে যেহেতু পর্যটক সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। ঈদে বা লম্বা কোনো ছুটি পেলেই সামর্থ্যবানরা বিদেশ ভ্রমণে যান। এক্ষেত্রে পছন্দের তালিকায় থাকে ভারত বা সৌদি আরবের মতো দেশগুলো।

সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘ট্যুরিজম স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট’ শীর্ষক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। জরিপে বলা হয়েছে, বিদেশ ভ্রমণকারীদের মধ্যে ৬০ শতাংশ মানুষ ভারতে যান। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সৌদি আরবে ৮ দশমিক ১২ শতাংশ এবং মালয়েশিয়া ভ্রমণে যান ৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ বাংলাদেশি।

এ বিষয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. কামরুল ইসলাম দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে বিশেষ করে মালদ্বীপ, কলকাতা ও দোবাই এ তিনটি দেশের  ফ্লাইটে কিছুটা বাড়তি চাপ আছে। তাছাড়া কাঠমুণ্ডু, ব্যাংকক এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও টিকিট কাটছেন দেশীয় পর্যটকরা। তবে সব দেশে এখনো পুরোপুরি ওপেন হয়নি। তাই যেখানে করোনার বিধিনিধেষ কম সেখানে ছুটছেন পর্যটকরা। আর দেশীয় বিভিন্ন গন্তব্যের মধ্যে রাজশাহী, বরিশাল, যশোর ও সিলেটে এখন ফ্লাইটের চাপ বেশি। আর ঈদের পর কক্সবাজারে বেশি চাহিদা বলে জানান ইউএস-বাংলার এ কর্মকর্তা।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় দেখা গেছে করোনায় দেশের হসপিটালিটি অ্যান্ড ট্যুরিজম সেক্টরের ক্ষতি হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর পাশাপাশি এ খাতের প্রায় ১ লাখ ৪১ হাজার মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। মোট ক্ষতির মধ্যে পরিবহনে ৪০ শতাংশ, হোটেলে ২৯ শতাংশ এবং রিসোর্ট ও রেস্তোরাঁয় ক্ষতি ২৫ শতাংশ। আসন্ন পর‌্যটন মৌসুমে এ ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাড়াঁবার স্বপ্ন দেখছে এ খাতের সাথে জড়িত কয়েক লাখ ব্যবসায়ী।

সংবাদটি শেয়ার করুন