শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কিশোর মনে দানবীয়তা

কিশোর মনে দানবীয়তা

বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সত্তরোর্ধ আব্দুর রহমান। হাতে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র। ওধুষ কেনার জন্য ফার্মেসি খুঁজছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দ। কানে তালা লাগানোর মতো অবস্থা। একদল কিশোর মোটরসাইকেলে বিকট শব্দ তুলে দ্রুতবেগে পার হয়ে গেল। ভয়াবহ শব্দে মাথা ঘুরে গেল আব্দুর রহমানের। খানিকটা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কোনোমতে পাশের চায়ের দোকানে গিয়ে বসলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক হয়ে বাড়ির পথ ধরলেন।

সেই যুবকদের মাথায় কোনো হেলমেট নেই। মোটরসাইকেলের হাইড্রোলিক হর্নের কানফাটা শব্দ। স্টিকার আর বাহারি রঙের ব্যবহারে বোঝার উপাই কী ব্রান্ডের মোটরসাইকেল। সবারই বয়স আঠারোর নিচে। তাদের আচরণ উগ্র। কোনো আইনেরই থোড়াই কেয়ার। দেখার কেউ নেই। কিছু বললেই বিপদে পড়তে হয়। হয় মেরে রক্তাক্ত কিংবা হত্যা। সামাজিক অবক্ষয়ের হাত ধরে এভাবেই বিপদগামী হয়ে পড়ছে অসংখ্য শিশু-কিশোর।

গ্রাম কিংবা শহরের রাস্তায় রাস্তায় কিশোরদের বাইক নিয়ে মহড়া, মোড়ে মোড়ে বসে দলবেঁধে মোবাইলে ইন্টারনেট চালানো, স্কুল-কলেজ বা প্রাইভেট-কোচিং সেন্টারের আশেপাশের জটলা, অকারণে আড্ডায় কিশোরদের হৈহুল্লোর নিত্যদিন চোখে পড়ছে। সামাজিক অনুশাসন এখন আর কাজ করছে না। পরিবার, প্রতিবেশী, এলাকাভিত্তিক সংস্কৃতিচর্চা আর সামাজিক বন্ধন নষ্ট হয়ে পড়ছে। প্রযুক্তির অপব্যবহারে ফ্রাংকেনস্টাইন হয়ে উঠছে কিশোর-তরুণরা। জড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের অপরাধে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজ থেকে কিশোররা সঠিক শিক্ষা কিংবা সংস্কৃতির স্পর্শ পাচ্ছে না। বিপরীতে স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিরা তাদের ব্যবহার করছেন নিজেদের স্বার্থে। অনেকেই রাজনৈতিক প্রভাব খাটাতে গিয়ে অর্থের প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে কিশোর-তরুণদের সম্পৃক্ত করছেন অপরাধের সঙ্গে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ফায়দা লুটতে এভাবেই তৈরি হচ্ছে কিশোর গ্যাং। এমন পরিবেশ পরিস্থিতিতে আশ্রয়-প্রশ্রয়ে কচি মনের কিশোররা হয়ে উঠছে ভয়ঙ্কর উগ্র, হিংস্র।

আরও পড়ুনঃ  ঝড়-বৃষ্টি নিয়ে যা জানাল আবহাওয়া অফিস

পুলিশের অনুসন্ধানে উঠে আসে, তালিকাভুক্ত কিশোর অপরাধীদের মধ্যে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ৫০ শতাংশ, নিম্নবিত্ত ৪০ শতাংশ আর উচ্চবিত্ত ১০ শতাংশ রয়েছে। এদের ৫০ শতাংশই শিক্ষার্থী। যাদের বয়স ১৪ থেকে ২২ বছরের মধ্যে। ৩৫ ভাগ কিশোর আগে লেখাপড়া করলেও এখন করে না। এসব কিশোরের মধ্যে ৩৫ ভাগ মাদকাসক্ত, ১০ ভাগ অনিয়মিত মাদক সেবনকারী। প্রভাব আর আধিপত্য বিস্তারের জন্য এরা মারামারি, ছিনতাই, ইভটিজিংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।

রাজশাহী মহানগর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, নানা অভিযোগ পাওয়ার পর নগরীজুড়ে বিশেষ অভিযানে নামে রাজশাহী মহানগর পুলিশ। ২০২১ সালের অক্টোবরে নগরীর সব থানা কিশোর অপরাধীদের ধরতে পাড়া-মহল্লায় অভিযান চালায়। যাদের বিরুদ্ধে মাদকসংশ্লিষ্টতা বা বড় অপরাধের প্রমাণ মেলে তাদের পাঠানো হয় কারাগারে। বিভিন্ন সময়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পর পুলিশের কাছে আটক হয় অনেক কিশোর। মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পাওয়া বেশিরভাগই আবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে রাজশাহী মহানগরীর অন্তত ৫০০ কিশোরকে নজরদারিতে রেখেছে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী।

পুলিশ বলছে, এসব কিশোরের মধ্যে অনেকেই বড় ধরনের অপরাধ করে কারাগারে রয়েছে। কেউবা ছাড়া পেয়েছে। তাদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংরক্ষণ করছে মহানগর পুলিশ। রাজশাহী মহানগর পুলিশের কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক বলেন, কিশোর গ্যাং নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এসব কিশোরের সম্পর্কে তথ্য পায় পুলিশ। তারা যাতে নতুন করে অপরাধে না জড়ায়, সেটি নিয়েই কাজ করা হচ্ছে।

গত বছরের শুরুর দিকে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে রাজশাহী মহানগরীতে কিশোর অপরাধের বিষয়টি। মহানগরীতে ভয়ঙ্কর কিছু অপরাধে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় শিশু-কিশোরদের। ছোটোখাটো বখাটেপনা থেকে শুরু করে চুরি, ছিনতাই এমনকি হত্যাকাণ্ডেও তারা জড়িয়ে পড়ে। মাদকের সঙ্গে জড়িয়েছে অনেকেই। অনেকের চলাফেরাও বেপরোয়া। অনেক পরিবারও তাদের সন্তান নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পুলিশকে জানায় নিজেদের সন্তানদের অপরাধ কর্মকাণ্ডের তথ্য।

আরও পড়ুনঃ  পরিচয় মিলেছে রাস্তায় পড়ে থাকা দুই কোটি টাকা মূল্যের গাড়ির মালিকের

এমন নানা অভিযোগ পাওয়ার পর নগরীজুড়ে বিশেষ অভিযানে নামে রাজশাহী মহানগর পুলিশ। গত বছরের অক্টোবরে নগরীর সব থানা কিশোর অপরাধীদের ধরতে পাড়া-মহল্লায় অভিযান চালায়। যাদের বিরুদ্ধে মাদকসংশ্লিষ্টতা বা বড় অপরাধের প্রমাণ মেলে তাদের পাঠানো হয় কারাগারে। কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততা না পেলে বা ছোট অপরাধে জড়িতদের ছাড়া হয় মুচলেকা নিয়ে। অভিভাবকদের থানায় এনে সন্তানদের সম্পর্কে অবগত করা হয়। তাদের অপরাধের ধরন সম্পর্কে জানানো হয়। নিজেদের সন্তানদের ওপর নজর রাখতে অভিভাবকদের অনুরোধ জানায় পুলিশ।

রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ জানায়, কিছু কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য পাড়া-মহল্লার প্রভাবশালী, মাস্তান বা বড় ভাইদের হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। তারা একসঙ্গে মাদক সেবন, নারীদের উত্ত্যক্ত করাসহ ছোট ছোট ঘটনাকে কেন্দ্র করে মারামারি ও বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় খুন-ধর্ষণের মতো ঘটনাও ঘটায় তারা। অনেকেই একটি চক্র তৈরি করে অপরাধে জড়ায়, আবার অনেকে গ্যাং ছাড়াও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে- এমন তথ্য পায় পুলিশ।

রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক বলেন, ২০২০ সালে আমি যখন রাজশাহীতে যোগদান করি তখন এখানকার সাংবাদিক ভাইয়েরা বলেছিল, রাজশাহীতে প্রচুর পরিমাণে সাইবার ক্রাইম হয়। এরপর এক সপ্তাহের মাথায় আমি সাইবার ক্রাইম ইউনিট করি। সাইবার ইউনিট করার পর আমি দেখলাম, আমাদের এখানে সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা। বিশেষ করে মেয়েরা। এই পরিপ্রেক্ষিতে পাড়া-মহল্লায় আমরা দেখলাম কিশোররা ইভ টিজিংসহ বিভিন্ন অপরাধ করছে। এরপরই আমরা কিশোর গ্যাংয়ের ডাটাবেজ তৈরি করলাম। প্রায় সাড়ে চারশ কিশোরকে আমরা ধরতে পারলাম।

আরও পড়ুনঃ  এনবিআরের অর্থবছর শুরু বড় ঘাটতিতে 

মহানগর পুলিশ কমিশনার বলেন, কিশোররা কী করে, কোথায় যায়- সবকিছুই ডাটাবেজের মধ্যে করা হলো। প্রায় ৫০০ ছেলেমেয়েকে এই ডাটাবেজের আওতায় আনা হলো। পরে তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা হলো। তারা মুচলেকা দিয়ে ছেলেদের নিয়ে গেলেন। পুলিশের কাছে এখন পাড়া-মহল্লার বখাটেদের তালিকা রয়েছে। তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

পুলিশ কমিশনার বলেন, আমরা শুধু মুচলেকা দিয়েই ছেড়ে দেইনি। তাদের পরিবারকে বলা হয়েছে নজর রাখতে। আমাদের প্রতিটি থানায় পুলিশ সদস্যরাও তাদের নজরে রাখছেন। তারা আবারও কোনো অপরাধে জড়িত হলে আমরা প্রচলিত আইনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন