শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উপকূলে ভরসা বৃষ্টির পানি

উপকূলে ভরসা বৃষ্টির পানি

বাংলাদেশ নদ-নদী আর খাল-বিলে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা দেশ হলেও দিন দিন সুপেয় পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে এই সংকট। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট বর্তমানে অসহনীয় হয়ে উঠেছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, গেল ২৫ বছরে উপকূলীয় জেলাগুলোর পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা গড়ে বছরে ২৬ শতাংশ হারে বেড়ে যাচ্ছে।

সুপেয় পানির সংকটের পাশাপাশি পানিতে লবণাক্ততা বাড়ার ফলে উপকূলীয় বাসিন্দাদের রোগব্যধি যেমন বেড়ে যাচ্ছে, তেমিন নানা ধরনের সমস্যায় পড়ছেন বিশেষ করে নারীরা। শুধু পানির অভাবেই শত শত মানুষ উপকূল ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। এতে একদিকে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা বাড়ছে অন্যদিকে বাস্তুচ্যুত মানুষ শহর এলাকায় আশ্রয় নেয়ায় সেখানেও পরিবেশগত সমস্যা দেখা দিচ্ছে। গবেষণার তথ্য বলছে, সংকটময় এই পরিস্থিতির উন্নতি না হলে উপকূলীয় এলাকায় ২০৫০ সাল নাগাদ জনসংখ্যা আরও ১৩ লাখ কমে যেতে পারে।

এমন পরিস্থিতিতে সরকার দেশের উপকূলীয় এলাকায় নিরাপদ পানি সরবরাহের কাভারেজ বাড়িয়ে সংকট হ্রাসের উদ্যোগ নিয়েছে। উপায় হিসেবে বৃষ্টির পানি সরবরাহের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। যার মাধ্যমে উপকূলীয় এলাকাবাসীর জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহের কাভারেজ ২০৩০ সাল নাগাদ ৬০ শতাংশের ওপরে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে গত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ‘উপকূলীয় জেলাসমূহে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে পানি সরবরাহ’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।

প্রকল্পের আওতায় থাকছে উপকূলীয় জেলা খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী ও কক্সবাজারের ২২২টি ইউনিয়ন। প্রকল্পের মূল কার্যক্রমের মধ্যে থাকছে দুই লাখ ছয় হাজার ৮৭২টি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং ইউনিট নির্মাণ। এ ছাড়া প্রকল্প এলাকায় সেফলি ম্যানেজড পানি সরবরাহের আওতা ২০৩০ সাল নাগাদ ৬০ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত করা হবে।

আগামী ২০২৪ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ শেষ হবে। এতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে মানুষকে লবণাক্ততা ও আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে, জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ডক্টর আইনুন নিশাত দৈনিক আনন্দবাজারকে বলেন, বৃষ্টির পানিতে কোনো লবণাক্ততা নেই। এটা মিঠাপানি। বৃষ্টির পানি ধরে রেখে, খাবার পানি সাপ্লাই দিলে এটা খুব ভালো সলিউশন।

আরও পড়ুনঃ  ভোজ্যতেলের দাম কমবে না: বাণিজ্যমন্ত্রী

ভূগর্ভস্থ পানির সংকট
ভূ-গর্ভস্থ পানি অন্তত বিশ্বের ৫০ ভাগ পান করা ও ৪০ ভাগ কৃষিতে ব্যবহারের জন্য ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সেই পানি প্রাকৃতিকভাবে মাটির নিচে একই হারে ভূগর্ভস্থ স্থানে যুক্ত হয় না। বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হারে কমে যাচ্ছে ভূগর্ভের পানির স্তর।

একটি জাতীয় দৈনিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক দিলীপ কুমার দত্ত বলেন, ভূগর্ভস্থ পানি হলো যেকোনো উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। ভূগর্ভস্থ পানির বয়স কমপক্ষে ৬০০ বছর থেকে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৫০০ বছর। এই ভূগর্ভস্থ পানি পূরণ হতে কমপক্ষে ৬০০ বছর লাগবে। বর্তমানে আমাদের উপকূলীয় এলাকায় কমপক্ষে ৯৮ শতাংশ মানুষ ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে যে পরিমাণ পানি তোলা হচ্ছে তা পূরণ হচ্ছে না। তাই ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক বড় বড় পুকুর, খাল, জলাশয় খনন করে তাতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

উপকূলের সংকট
লবণাক্ততার কারণে উপকূলের পুরো বাস্তুসংস্থান বদলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ৩২ শতাংশ অর্থাৎ ৪৭,২০১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের উপকূলে দেশের মোট জনসংখ্যার ২৯ শতাংশ বা সাড়ে তিন কোটি মানুষের বসবাস। ১৯টি জেলাকে উপকূলীয় জেলা হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৭-১৮ বছরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের উপকূলীয় জেলা ১৫টি। এসব জেলার ১৩১টি উপজেলা লবণ পানির আগ্রাসনে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত।

উপকূলের নদনদী, পুকুর, জলাশয়ে শুকনা মৌসুমের শুরু থেকেই পানির লবণাক্ততা দেখা দেয়। নভেম্বর থেকে ধীরে ধীরে পানি লোনা হতে শুরু করে। গরমের সময় প্রাকৃতিক উৎস বেশিরভাগই অচল থাকে। ফলে মানুষকে এই সময় পানি কিনে খেতে হয়। এই পানির দাম প্রতি লিটার এক টাকা। হতদরিদ্র পরিবারের পক্ষে ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা খরচ করে প্রতি লিটার পানি কেনা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রয়োজনের তুলনায় কম বৃষ্টিপাত, নদীর নাব্যতা হ্রাস ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া প্রভাব পড়ছে টিউবওয়েলের ওপরও। টিউবওয়েল থেকেও মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় কম পানি পাচ্ছে। আর লবণাক্ততার কারণে এ সব উৎসের পানি ব্যবহারও দুরূহ হয়ে উঠেছে।

আরও পড়ুনঃ  খোলা থাকবে যেসব দোকান

পানি সংকটের প্রভাব
উচ্চমাত্রার লবণাক্ততার কারণে এবং দীর্ঘমেয়াদি টেকসই সমাধানের অভাবে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ নিরাপদ খাওয়ার পানির অভাবে ভুগছে। যার ফলে এসব এলাকার মানুষজন নানা ধরনের পানিবাহিত রোগে ভুগছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিশুমৃত্যুর পাঁচটি প্রধান কারণের চারটিই দূষিত পানি পানের সঙ্গে সম্পর্কিত। সুপেয় নিরাপদ পানির অভাবে রোগ-ব্যধির হার বৃদ্ধি, স্কুল এবং কর্মক্ষেত্রে উপস্থিতির হার এবং সামগ্রিক জীবনের গুণগত মানও উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচই) ২০১২ সালের গবেষণা মতে, উপকূলীয় অঞ্চলের ৬১ শতাংশ জনগোষ্ঠী গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার মুখোমুখি। নিরাপদ পানির অভাবে নারীরা; বিশেষ করে কিশোরীরা সবচেয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে। পানি কম পান করার কারণে নারীরা উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং শুধু নারীদের মধ্যেই এটি সীমাবদ্ধ থাকছে না, নবজাতক শিশুদের স্বাস্থ্যও প্রভাবিত হচ্ছে। অধিকাংশ নারী জরায়ুর জটিলতায় ভুগতে থাকেন। কম বয়সেই প্রজননক্ষমতা হারিয়ে বসেন কেউ কেউ।

বৃষ্টির পানিই ভরসা
উপকূলীয় এলাকাবাসীদের লবণাক্ততা ও আর্সেনিকমুক্ত নিরাপদ পানি সরবরাহের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, উপকূলীয় ১০ জেলার ৪৪টি উপজেলায় ‘উপকূলীয় জেলাসমূহের বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে পানি সরবরাহ’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। এতে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। ২০৩০ সালের মধ্যে ৬০ ভাগ নিরাপদ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেয়া হবে। স্থানীয় সরকারের উদ্যোগে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর প্রকল্পটি ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের জুন মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে।

প্রকল্প প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের মূল শিকার দেশের উপকূলীয় এলাকাগুলো। এর প্রভাবে সমুদ্রের পানিস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শুধু ভূ-উপরিস্থিত নয়, বরং ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরেও লবণাক্ততা ছড়িয়ে পড়েছে। কোনো কোনো এলাকা এমন রয়েছে, যেখানে কোনো পানযোগ্য পানির উৎস আর পাওয়া যায়নি। এমনকি নদী-খাল-বিল-পুকুরের পানি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে, যা শুষ্ক মৌসুমে আরো প্রকট আকার ধারণ করে। এসব উৎসর পানি পান করা ও গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার করা যায় না। এই লবণাক্ত পানি পান করে উচ্চ রক্তচাপ, নারীদের গর্ভকালীন বিভিন্ন জটিলতা, কিডনি রোগ ও চর্মরোগের মতো নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে উপকূলীয় এলাকার মানুষ। ক্যান্সারের মতো জটিল রোগ থেকে বাঁচতে অনেক নারীকে জরায়ু কেটে ফেলতে হচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ  সেচ সুবিধার আওতায় ৫ হাজার কৃষক

প্রকল্প পটভূমিতে বলা হয়েছে, উপকূলীয় কিছু এলাকায় পারযোগ্য পানির তুলনায় ২/৩ গুণ বেশি লবণাক্ততা পাওয়া যাচ্ছে। তাই এসব এলাকায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হবে। বিশ্বের অনেক দেশের এভাবে পানি সংরক্ষণ করা হয় বলেও উল্লেখ করা হয়। তাছাড়া খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা এলাকায় এখন ৬ হাজারের মতো রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং ইউনিট সচল রয়েছে।

প্রকল্পটি গ্রহণের জন্য পরিচালিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় ২০৩০ সালের মধ্যে ৮লাখ ৫৯ হাজার রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং ইউনিট নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে। প্রকল্পটি প্রথমে ২০১৯ সালে পরিকল্পনা কমিশনে আসে। প্রথমে ৪২০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হলেও ২০২০ সালে কমিশন মূল্যায়ন শেষে ৯৬২ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করে। পরে তা সংশোধন করা হয়।

উপকূলে স্বস্তি
প্রকল্পটি অনুমোদন করায় সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনসহ নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বধীন সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছে। এ প্রকল্পটি সম্পর্কে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে উপকূলীয় সাধারণ মানুষ আর্সেনিকের ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পাবে। একই সঙ্গে ‘সবার জন্য নিরাপদ পানি’ সরবরাহ নিশ্চিত করার সরকারের টার্গেট পূরণে সহায়ক হবে।

সুপেয় পানির প্রাপ্তির সুযোগ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘ পানি অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে। তবে নিরাপদ পানির অধিকারবঞ্চিত এই বিপুল জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই আবার চরম দরিদ্র। প্রান্তিক এ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ বাস করে গ্রামে। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে নারী ও শিশুরা।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন