শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শ্রমে সমান, মজুরিতে অর্ধেক

শ্রমে সমান, মজুরিতে অর্ধেক

আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ

  • কিস্তি দিতে বাইরে শ্রমবিক্রি 

আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ‘নারীর সুস্বাস্থ্য ও জাগরণ’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এবারে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে যখন নারীর প্রতি সব রকম বৈষম্য ও অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটিয়ে একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক বিশ্বগড়ার কাজে পুরুষের সমান অবদান রাখার প্রত্যয় নিয়ে সভা-সেমিনার-মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে, ঠিক তখনি উত্তরের চরাঞ্চলের নারীরা রোদে পুড়ে সস্তা মজুরীতে মাঠে শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। 

এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, এগিয়ে যাবেই দেশ-স্বপ্নের মত সুন্দর আজ ডিজিটাল বাংলাদেশ’ উন্নয়নের এই শ্লোগানের সঙ্গে নারীরাও সম্পৃক্ত। তাদের ছাড়া উন্নয়ন অসম্ভব। অথচ ইদানীংকালে বিশেষ করে উত্তরে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। মজুরী প্রদানে বৈষম্য থাকলেও মুলত ঋণের কিস্তি পরিশোধে এক প্রকার বাধ্য হয়েই তারা সন্তান-সংসারের মায়া ত্যাগ করে মাঠে-ঘাটে শ্রম বিক্রি করছেন। 

তিস্তা প্রতিরক্ষা বাঁধসহ রংপুরের চরাঞ্চলে প্রায় ৫০ হাজার পরিবারের বাস। এক সময়ের অবস্থাসম্পন্ন এসব পরিবার নদী ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে কোনমতে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছেন তিস্তা কূলবর্তী এলাকাগুলোতে। শ্রম বিক্রিই তাদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন। বছরের বিভিন্ন সময়ে এলাকায় কোন কাজ না থাকায় পরিবার প্রধানরা কাজের সন্ধানে ছুটে যান ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। তারপরও দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতিসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে বেসরকারি সংস্থাগুলোর ঋণের জালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে পরিবারগুলো। এ কারণে এক রকম বাধ্য হয়েই নারীরা লাজ-লজ্জা ভুলে শ্রম বিক্রি করছেন মাঠে-ঘাটে। 

আরও পড়ুনঃ  প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলার ঘোষণা

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, তিস্তার চরাঞ্চলসহ সর্বত্র এখন চলছে আলু, তামাক, সরিষাসহ রবি ফসল উত্তোলনের মহোৎসব। আর এসব কাজে নিয়োজিত রয়েছেন নারী শ্রমিকরা। রংপুরের গঙ্গাচড়ার লক্ষ্মিটারী ইউনিয়নের ইচলী চরে এক সাথে আলু তোলার কাজ করছিলেন প্রায় ৫০ জন নারী শ্রমিক। এসময় নিলুফা বেগম, জরিনা বেগম, জশো মাই, আলেমা বেওয়া জানান, প্রতিদিন সকাল ৮ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত কাজের বিনিময়ে তারা মজুরী পান মাত্র ২০০ টাকা। সমপরিমান কাজের জন্য পুরুষ শ্রমিকদের মজুরী দেওয়া হয় ৪০০ টাকা। শংকরদহ চরের জুলেখা, ছুরতন নেছা ও সবজান বেগম জানান, সংসার জীবনে এই প্রথম তারা বাড়ি বাহিরে মাঠে আলু উত্তোলনে শ্রম বিক্রি করছেন। কারণ জানতে চাইলে আঁচলে মুখ লুকিয়ে তারা বলেন, ‘প্রতি সপ্তায় কিস্তির টাকা দেওয়া নাগে। কাম (কাজ) না করলেতো হামার মরণ।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চরাঞ্চলে এমন কোন অভাবি পরিবার নেই যারা বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) কাছে ক্ষুদ্র ঋণ নেয়নি। কেউ কেউ একাধিক সংস্থার কাছেও ঋণ নিয়েছেন অভাবের কারণে। প্রতি সপ্তাহে ২৫০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণের কিস্তি জমা দিতে হয় তাদের। জয়রামওঝা চরের বিউটি বেগম জানান, মেয়ের বিয়ে দিতে ৬ মাস আগে ব্র্যাকের কাছে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ওমার কামাইয়ে (স্বামীর আয়ে) কোনমতে খাওয়া চলে। আর নিজের কামাইয়ে ঋণের কিস্তি দেই।’ জোবেদা খাতুন বলেন, ‘মানুষটাতো (স্বামী) বিদেশোত (ভিন্ন জেলায়) কাম করে। মোকে কাম করি ঋণের কিস্তি দেওয়া নাগে।’ অভারের সময় বাঁচার তাগিদে বেসরকারি সংস্থার কাছে ১৫ হাজার টাকা তিনি ঋণ নিয়েছিলেন। জয়রামওঝা এলাকার ইউপি সদস্য দুলাল মিয়া জানান, বর্তমানে এলাকায় একজন শ্রমিকের মজুরী চলছে ৪০০ টাকা। আর নারী শ্রমিক হলে তার মজুরী দেওয়া হয় ২০০ টাকা। লক্ষ্মিটারী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী জানান, চরাঞ্চলের পরিবারগুলো বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার ঋণের জালে আটকা পড়েছেন। সারাবছরই তাদের সাপ্তাহিক হিসেবে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। মজুরীতে বৈষম্যের বিষয়টি নিশ্চিত করে তিনি বলেন, ঋণের কারণে দিন দিন নারী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। আর মহাজনরা সে সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছেন।

সংবাদটি শেয়ার করুন