বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাগে আসছে না তামাক

বাগে আসছে না তামাক

নিয়ন্ত্রণে আইন সংশোধনের প্রস্তাব

  • তামাকে বছরে বিশ্বে মৃত্যু ৬০ লাখ
  •  দেশে বছরে মৃত্যু ১ লাখ ৬১ হাজার
  • ২০১৮ সালে আর্থিক ক্ষতি জিডিপির ১.৪ ভাগ
  • বছরে বাড়তে পারে ১ কোটি তরুণ ধূমপায়ী

আইনের দুর্বলতা ও বাস্তবায়নের সীমাবদ্ধতায় তামাক ব্যবহার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। পাশাপাশি তরুণদের মাঝে ই-সিগারেটের ব্যাপক প্রসারের ফলে সরকারের তামাকমুক্ত লক্ষ্য বাস্তবায়ন সম্ভব কিনা সে প্রশ্ন উঠছে দফায় দফায়। তাই লক্ষ্য বাস্তবায়নে ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন সংশোধন করতে সব পক্ষের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে পরামর্শ দিয়েছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশের ৩৫.৩ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কোনো না কোনো তামাক গ্রহণ করে থাকে। তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে বছরে মৃত্যু হয় এক লাখ ৬১ হাজার মানুষ। তামাকের এই ভয়াবহতা উপলব্ধি করে আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৬ সালে দক্ষিণ এশিয়ার স্পিকার সম্মেলনে এ ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি।

গতকাল রাধানীর সিরডাপে ‘বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিং’ আয়োজিত ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে এ কথা বলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী। আয়োজনে ফোরামের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত এমপির সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ.ফ.ম রুহুল হক এমপি।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনা মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। এটা একটি সাহসী ঘোষণা। লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমরা তাকে সহায়তা করবো। এটা অর্জন করা সম্ভব। তামাক আইন সংশোধনে সকল পর্যায়ে চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। আমাদের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এগোতে হবে। তবে তামাকের পক্ষের একটি শ্রেণি সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালি বলেও স্বীকার করেন মন্ত্রী।

আরও পড়ুনঃ  ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহত শিশুদের পাশে লিডো

সভায় সংসদ সদস্যদের তামাক বিরোধী এ সংস্থার কো চিয়ার ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারি এমপি মূল প্র্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এতে বলা হয়, দেশের ৩ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ তামাক ব্যবহার করছেন। যেখানে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন আরো ৩ কোটি ৮৪ লাখ মানুষ। ফলে ২০১৮ সালেই এক লাখ ৬১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। যা দেশের মোট মৃত্যুর প্রায় ১৩.৫ শতাংশ। যেখানে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।

আইনের দুর্বলতা

মূল প্রবন্ধে দেশের তামাক আইনের দুর্বতলা তুলে ধরে ব্যারিস্টার পাটোয়ারি জানান, দেশের সব পাবলিক প্লেস-পরিবহনে এখনো পুরোপুরি ধূমপান নিষিদ্ধ করা যায়নি। যেখানে নেপাল, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের ৬৭ দেশে পাবলিক প্লেসে ধূমপান পুরোপুরি নিষিদ্ধ। দেশে এটা কার্যকর করা গেলে ৮৫ ভাগ পর্যন্ত হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব হবে।

অন্যদিকে বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে তামাক পণ্যের প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা যায়নি। কিন্তু নেপাল, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের ৪৮টি দেশের বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকজাত দ্রব্যের প্রদর্শনী সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। গবেষণায় দেখা গেছে প্রদর্শন বন্ধ করা গেছে ধূমপান প্রায় ৭ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করা যায়।

আরেকটি বড় প্রতিবন্ধকতা হলো তামাক কোম্পানিগুলোর ‘করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা’(সিএসআর) কার্যক্রম। সিএসআরকে কাজে লাগিয়ে কোম্পানিগুলো রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্ধারকদের প্রভাবিত করে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে তামাক কোম্পানির প্রভাব সবচেয়ে বেশি। তবে নেপাল, রাশিয়াসহ বিশ্বের ৬২ দেশে সিএসআর কার্যক্রম নিষিদ্ধ রয়েছে।

বিড়ি-সিগারেটের খুচরা বিক্রিতে শিশু-কিশোররা খুব সহজে তামাকপণ্য ক্রয়ের সুযোগ পায়। তাই খুচরা শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধের দাবি দীর্ঘ দিনের। মালয়েশিয়া থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের ১১৮টি দেশে সিঙ্গেল স্টিক বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ৫৮টি দেশে প্রতি প্যাকেটে ২০ শলাকা নির্ধঅরণ করা হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  শেখ রাজিয়া নাসের’র মৃত্যুতে মোল্লাহাটে কোরআন খানি

ই-সিগারেটকে স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্ণিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা।  প্রতিবেশি ভারতসহ বিশ্বের ৫০ দেশে এসব পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে দেশের আইনে এ বিষয়ে কোন উল্লেখ করা হয়নি।

অন্যদিকে তামাকের প্যাকেটে মাত্র ৫০ ভাগ জায়গাজুড়ে স্বাস্থ্য সতর্কতা দেয়া হচ্ছে। যেখানে বিশ্বের ৭৫ দেশে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি জায়গাজুড়ে এসব সচিত্র সতর্কতা দেয়া হচ্ছে। গবেষণা বলছে, সচিত্র সতর্কতার আকার বাড়ানো গেলে তা তামাকে নিরুৎসাহিত করে থাকে। তাই তা ৯০ ভাগ জায়গাজুড়ে নির্ধারণ করার দাবি করা হয়।

আইন তৈরিতে এক বছর দেরি হলে নতুন করে এক কোটি তরুণ ধূমপানে যুক্ত গতে পারে বলেও সতর্ক করেন ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারি।

তামাকের প্রসার

দেশের ৩৫.৩ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। যাদের মধ্যে পুরুষ ৪৬ ভাগ। অপ্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যেও ৬.৯ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে তামাক ব্যবহার করেন। তবে শঙ্কার বিষয় হলো এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের নারীরা ধূমপানের দিক দিয়ে সবার চেয়ে এগিয়ে আছে। চীনে যেখানে মাত্র ২.১ শতাংশ নারী ধূমপান করে এবং ভারতে ১৪.২ শতাংশ নারী ধূমপায়ী রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশে ২৫.২ শতাংশ নারী ধূমপান করে থাকে। এ বিষয়ে উম্মে ফাতেমা নাজমা এমপি বলেন, ‘সন্ধ্যা হলেই অলি-গলিতে মেয়েদের সিগারেট হাতে দেখা যাচ্ছে। ফলে অনেকের বাচ্চা হচ্ছে না, অপরিপক্ত সন্তান হচ্ছে।’

দেশে এখন ৬১ হাজারের বেশি শিশু পরোক্ষ ধূমপানের ফলে বিভিন্ন রোগে ভুগছে। তামাক ব্যবহারের ফলে ফুসফুসের ক্যান্সারের ৫৭ ভাগ ঝুঁকি থাকে এবং অন্যান্য ক্যান্সারের ঝুকি থাকে ১০৯ শতাংশের বেশি। তাছাড়া ২৫-৬৯ বছর বয়সি ধূমপায়ীদের মৃত্যু ঝুঁকি থাকে ৭০ শতাংশের বেশি।

আরও পড়ুনঃ  আম্পানের তাণ্ডবে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৫

তামাকের ক্ষতি

বিশ্বে তামাক ব্যবহারকারি অর্ধেক মানুষেরই মৃত্যু হয়ে থাকে এর ক্ষতিকর প্রভাবে। বিশ্বে সরাসরি তামাক গ্রহণের কারণে ৬০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগে মোট মৃত্যুর প্রায় ৩০ ভাগ মৃত্যু হয়ে থাকে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, তামাকের কারণে ২০১৮ সালে  জিডিপির প্রায় ১.৪ ভাগ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। যেখানে চিকিৎসা ব্যয় হয়েছে ৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। আর অকালমৃত্য ও পঙ্গুত্বের কারণে উৎপাদনশীলতা হরানোর ক্ষতি হয়েছে ২২ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। যেখানে পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতি মোট আর্থিক ক্ষতির ১৩.৫ শতাংশ।

সভায় বিশেষ অতিথি রুহুল হক বলেন, ‘আপনারা অনেকেই প্যাসিভ স্মোকিং এর কথা জানেন। একজন ধূমপান করেন, কিন্তু সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হন। বিশেষ করে তরুণ এবং নারীদের মধ্যে এটা বেশি হচ্ছে।’ ইতোমধ্যে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করার দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১৫৩ জন এমপির চিঠি দিয়েছেন। তাছাড়া তামাক আইন সংশোধনের দাবিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নিকট ১৫২ জন সংসদ সদস্যের চিঠি দেওয়া হয়েছে।

সভায় উপস্থিত অন্যান্য সংসদ সদস্যরা তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করা ও তামাক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি নিজ নিজ এলাকায় তামাক বিরোধী কাযর্ক্রম পরিচালনায় একমত পোষণ করেন।

সভায় অন্যান্য সংসদ সদস্যদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন ডা. শামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল এমপি, অ্যাডভোকেট সৈয়দা রুবিনা আক্তার এমপি, অপরাজিতা হক এমপি, শবনম জাহান এমপি, জনাব উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগম এমপি। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী জনাব হোসেন আলী খোন্দকার, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিবৃন্দ এবং তামাক-বিরোধী সংস্থা, অন্যান্য এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ।

সংবাদটি শেয়ার করুন