শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অনিশ্চিত এক গন্তব্যে বিশ্ব

অনিশ্চিত এক গন্তব্যে বিশ্ব

নব্বইয়ের দশকে রাশিয়ার কর্মকর্তারা পশ্চিমাদের সতর্ক করে বলেছিলেন, রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টার ফলে সেখানে জাতীয়তাবাদী ও স্বৈরাচারী শক্তির উত্থান ঘটবে। পুতিন নিজেও তার সর্বশেষ ভাষণে বলেছেন, পশ্চিমারা ক্রমাগত রাশিয়াকে একঘরে করে রাখার চেষ্টা করে গেছে।

প্রেসিডেন্ট ওবামা একবার ঠাট্টা করে বলেছিলেন, রাশিয়া এখন কেবল একটি বড় শক্তি ‘মেজর পাওয়ার’, সে পরাশক্তি নয়। পুতিন হয়তো সে কথা ভুল প্রমাণ করতে চলেছেন। তবে একুশ শতকে এসেও যে একটি বৃহৎ শক্তিধর দেশ তার প্রতিবেশী দুর্বল দেশের ওপর কোনো উসকানি ছাড়া এমন সর্বাত্মক হামলা চালাবে, তা অনেকেরই চিন্তার বাইরে ছিল। বাইডেন প্রশাসন এক মাস ধরে বলে আসছে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের উদ্দেশ্যে তাকে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। অনেকেই এটাকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রপাগান্ডা ভেবেছিল। এখন যা ঘটতে যাচ্ছে তা হয়তো ধারণার চেয়ে বিপর্যয়কর হতে যাচ্ছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় ধরণের ঝুঁকি তৈরি করেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। গত শতকের শেষভাগে শীতল স্নায়ুযুদ্ধ চললেও এবার অনেকটাই সামনে এসে দাঁড়িয়েছে দুই পরাশক্তি। তবে রাশিয়া মরিয়াভাবে যুদ্ধের মনোভাবের সামনে এখনো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আর প্রতিরক্ষা কৌশল-অস্ত্র সরবরাহে সীমাবদ্ধ থাকছে ন্যাটো জোট। তবে প্রায় ৫০ হাজার কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বসে থাকা রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বশে আনাটা কতটা বাস্তাবসম্মত তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট।

বিগত কয়েকটি ব্যর্থ যুদ্ধের গ্লানি আর অর্থনৈতিক ক্ষতি তাই চুলচেরা হিসেব কষতে বাধ্য করছে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও ধনী ৩০টি দেশ ও সর্বাধুনিক সামরিক বাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে নিয়ে গঠিত ন্যাটো জোটের নেতৃত্বে থাকা আমেরিকাকে।

আরও পড়ুনঃ  অনলাইনে দেড় শতাধিক সেবা দেবে বিডা

পট-পরিবর্তন

২০০২-২০০৩ সালে আমেরিকা সামরিক শক্তির দিক থেকে চূড়ায় পৌঁছেছিল। সে সময়ের রাশিয়ার ক্ষমতা ও প্রভাব আজকের দিনের ধারে কাছেও ছিল না। মস্কো আমেরিকার আগ্রাসনের বিরোধিতা করেছিল। তাতে ইরাকে আগ্রাসন থামানো যায়নি। তবে সময়ের সঙ্গে বদলেছে শক্তি আর সামর্থ্য। দেশে দেশে ২০ বছরের ব্যর্থ যুদ্ধে আমেরিকা এখন পর্যুদস্ত। তাদের অর্থনীতিতেও চলছে অস্থিরতা। এতোদিন এশিয়া আর মধ্যপ্রাচ্যে মনযোগ রাখছিল আমেরিকা।

এদিকে ২০০৮ সালের দিকে রাশিয়ার জিডিপি ও সামরিক ব্যয় আবার ঘুরে দাঁড়ায়। আর রাশিয়া এখন শীতল যুদ্ধের পর সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে। শীতল যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে এক ব্যয়বহুল যুদ্ধে শামিল হয়েছিল। এরপর দক্ষিণ ভিয়েতনামকে স্বাধীন রাখতে মার্কিন পরাশক্তিকে আরো ব্যয়বহুল এক যুদ্ধ চালাতে হয়েছিল এবং অবশেষে সেখানে ব্যর্থও হয়েছিল তারা। ওই দুটি যুদ্ধ এশিয়ায় ২০ বছর স্থায়ী হয়েছিল, ৯০ হাজারের বেশি মার্কিন সেনা তাতে নিহত হয়েছিলেন। সব মিলিয়ে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ। তাই আরেকটি চূড়ান্ত পর্যায়ের যুদ্ধে জড়ানোর সাহস করা সহজ হবে না বাইডেনের জন্য।

কেন বেপোরোয়া রাশিয়া

স্নায়ুযুদ্ধের কালে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থান মোকাবেলায় মিত্রদের নিয়ে ন্যাটো জোট গঠন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এর বিপরীতে সোভিয়েত নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ওয়ারশ জোট। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ওয়ারশ জোট ভেঙে গেলেও কার্যক্রম চালু রাখে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো। বিষয়টিকে রাশিয়ানরা কখনই ভালো চোখে দেখেনি। তবে শক্তিমকত্তা হারিয়ে ফেলায় কখনো রাশিয়ার উদ্বেগে কর্ণপাত করেছি যুক্তরাষ্ট্র।

আরও পড়ুনঃ  জ্বালানি তেলের উত্তোলন কমিয়েছে ওমান

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মস্কো আশা করেছিল, শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপে যে নতুন নিরাপত্তাকাঠামো গড়ে উঠবে, রাশিয়া তার অন্তর্ভুক্ত হবে। শোনা যায় ওয়াশিংটন মৌখিকভাবে তেমন আশ্বাসও দিয়েছিল, বাস্তবে ঘটে ঠিক উল্টো। ন্যাটোর জাল দিয়ে চারদিক থেকে ধিরে ধরছিল রাশিয়াকে। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোসহ তিনটি প্রজাতন্ত্রে জোটটি সামরিক সম্প্রসারণ করেছে। দেশটির সীমান্তবর্তী- লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়াকে ন্যাটোতে নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি ইউক্রেনের ন্যাটোয় যোগদানের বড় সম্ভাবনা তৈরি হয়। নিজ সীমান্তে ন্যাটোর উপস্থিতির সম্ভাবনা ক্ষুব্ধ করে তোলে রাশিয়াকে। রাশিয়ার আজকের এ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার পেছনের কারণগুলোর মধ্যে এগুলো অন্যতম।

২০১৪ সালের মস্কোবিরোধী ‘ময়দান বিপ্লবে’র পর নতুন যে সরকার ইউক্রেনে প্রতিষ্ঠিত হয়, তারাও ন্যাটোর সদস্য পদের জন্য আবেদন করলে পুতিনের জন্য তা ‘রেড লাইন’ হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৪ সালের সেই বিপ্লবের সরাসরি প্রতিক্রিয়া হিসেবে মস্কো প্রথমে ক্রিমিয়া দখলে নেয়। ইউক্রেন ২০১৪ সালের হামলার মতো রাশিয়ার ভবিষ্যৎ আগ্রাসন থেকে সুরক্ষা পেতে চায়। এজন্য তারা ন্যাটোর সহযোগিতা সদস্য হতে চেয়েছিল। তবে এখন অনেকটা একাই লড়তে হচ্ছে দেশটিতে।

রাশিয়ার অনেক কর্মকর্তা ১৯৯০-এর দশকে পশ্চিমাদের সতর্ক করেছিলেন, রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টার ফলে সেখানে জাতীয়তাবাদী ও স্বৈরাচারী শক্তির উত্থান ঘটবে। পুতিন নিজেও তার সর্বশেষ বক্তৃতায় বলেছেন, রাশিয়াকে পশ্চিমারা ক্রমাগত একঘরে করে রাখার চেষ্টা করে গেছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন