- মনোরঞ্জনে বাড়ছে সুন্দরবনে হরিণ শিকার
- আইনের তোয়াক্কা করছেন না কেউই
- জড়িত অনেক বন কর্মকর্তা ও বনরক্ষীও
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের তোয়াক্কা না করে অবাধে চলছে সুন্দরবনের হরিণ শিকার। শতাধিক সংঘবদ্ধ চোরা শিকারিরা ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে গোপন আস্তানায় মাংস তৈরি করে সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করছে। এমনকি শিকারীদের থেকে কিনে পাঠানো হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রভাবশালীদের মনোরঞ্জনে। নির্মূলে সচেতনতা বৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে মনে করে বন বিভাগ চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে উপকূলীয় এলাকায় নিয়মিত উঠান বৈঠক করে যাচ্ছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কয়রার জোড়শিং, আংটিহারা, তেতুলতলার চর, শ্যামনগর, মোংলা, শরণখেলাসহ সুন্দরবনের আশপাশ এলাকায় বেশি হরিণের মাংস পাওয়া যায়। বন বিভাগের টহল টিমের সদস্যদের অভিযানে মাংস-ফাঁদ উদ্ধার হলেও আসামী আটকের সংখ্যা কম। তাছাড়া আটককৃতদের অধিকাংশই আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসে পুনরায় শিকার চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় জেলেদের অভিযোগ শুধু জেলে, বনজীবী ও স্থানীয় বাসিন্দারা নয়, হরিণ শিকার ও পাচারের সহযোগী হিসাবে বন কর্মকর্তা ও বনরক্ষিরাও জড়িত।
তবে বন বিভাগের দাবি, পেশাদার হরিণ শিকারী অনেকাংশে কমেছে। তবে বেড়েছে অতিথি অ্যাপায়নের জন্য আকস্মিক শিকারীর সংখ্যা। আর এসবের সাথে জড়িত স্বয়ং প্রশাসনের কর্মকর্তারাও। বন বিভাগ সূত্রে আরও জানা যায়, দেশের বিভিন্নস্থান থেকে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সুন্দরবন এলাকায় ঘুরতে আসলে হরিণের মাংস খাওয়া যেন এখন অভিজাত্যের বিষয়। তাছাড়া আবদার অনুযায়ী কিংবা খুশি করার জন্য মাংস পাঠানো হয় বিভিন্ন স্থানের প্রভাবশালী, রাজনৈতিক ব্যক্তি এমনকি প্রশাসনের উর্দ্ধতনদের কাছে।
তবে এলাকাবাসি সূত্রে জানা যায়, বনবিভাগের তৎপরতায় আগের মত ঘরে ঘরে হরিণের মাংস খাওয়ার প্রবণতা কমলেও লোকালয়ে পাওয়া যায় না এমনটি নয়। সাধারণ মানুষ ভয়ে কিছুটা এড়িয়ে চললেও প্রভাবশালীদের কাছে রয়েছে ওপেন-সিক্রেট ঘটনার মতো।
তথ্যনুসন্ধানে জানা যায়, জেলে সেজে পূর্ব ও পশ্চিম সুন্দরবন থেকে পাশপারমিট নিয়ে বনে প্রবেশ করে হরিণ হত্যা ও পাচারের অপরাধে বিভিন্ন সময় জেলে ও বনজীবীদের আটক করা হয়েছে। এছাড়া পাশপারমিট বাদেও সুন্দরবনে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে হরিণ হত্যা ও পাচারের অপরাধেও আটক হয়েছে অনেকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের আওতাধীন কয়রার মহেশ্বরীপুর ও দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের কয়েকজন ব্যক্তি জানান, ওই এলাকায় বেশ কয়েকজন শিকারী সুযোগ বুঝে হরিণ শিকার করে। মাংস পেতে শিকারী কিংবা সহযোগীদের আগে থেকে বলে রাখতে হয়। তাদের সুবিধামত যে কোন সময় বাড়িতে মাংস পৌঁছে দিয়ে আসে শিকারীরা।
এ ব্যাপারে খুলনার কয়রা উপজেলার হায়াতখালী ফরেষ্ট ক্যাম্পের অফিসার ইনচার্জ মোঃ মোসাররফ হোসেন অস্বিকার করে বলেন, হরিণ শিকারী নেই বললেই চলে। ৎ
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়রা, শরণখোলা, মোংলা উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার একাধিক জেলে ও বাসিন্দারা জানান, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ছত্রছায়ায় জেলে পরিচয়ে পাস পারমিট নিয়ে অনেকেই হরিণ শিকার ও পাচার করে যাচ্ছে। ছদ্মবেশে সুন্দরবনে প্রবেশ করা চোরা শিকারীরা সুন্দরবনের সংরক্ষিত এলাকায় অনুপ্রবেশ করে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে মাংস বিক্রি করে।
তারা আরও জানান, হরিণের মাংস এখন হোম ডেলিভারী করা হয়। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি ও খোদ প্রশাসনের লোকজনও এই মাংসের ক্রেতা। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকা গুলোতে বসবাস করা ধনী পরিবার ও রাজনৈতিক নেতাদের বাড়ির ফ্রিজেও রাখা হয় মাংস।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের সহকারি বন সংরক্ষক এম এ হাসান বলেন, চোরা হরিণ শিকারীদের তৎপরতা বন্ধে বন বিভাগ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। আগের মত পেশাদর শিকারী তেমন নেই। তবে হরিণের মাংস দিয়ে অতিথি অ্যাপ্যায়নের জন্য প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় আকস্মিক শিকার করতে দেখা যায়। এজন্য জনসচেতনতা বাড়াতে উঠান বৈঠক করে যাচ্ছি এবং এর মাধ্যমে ভালো ফলাফলও পাচ্ছি।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, আমরা ব্যাপকভাবে আসামী ধরেছি। উপকূলীয় কমিউনিটির সচেতনতা ছাড়া সুন্দরবন রক্ষা করা সম্ভব না। জানুয়ারী থেকে শ্যামনগরের কৈখালী থেকে দাকোপের কৈলাশগঞ্জ পর্যন্ত স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ জেলে ও শিকারীদের নিয়ে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরছি। ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে তাদেরকে সচেতন করে যাচ্ছি।