শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দোলাচলে লবণচাষিরা

দোলাচলে লবণচাষিরা

দেশের একমাত্র লবণ উৎপাদনকারী অঞ্চল কক্সবাজারের ছয় উপজেলা ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় এখন লবণ চাষের ভরা মৌসুম। তবে লবণ উৎপাদনের বিপুল পরিমাণ জমি এখনও ফাঁকা পড়ে আছে। মৌসুমের শুরুর দিকে কোনো কোনো উপজেলায় চাষিদের মাঠে নামতে দেখা গেলেও তা ছিল তুলনামূলকভাবে কম। উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল না পাওয়ায় চাষিরা অনেকটাই আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।

সূত্রমতে, গেল কয়েক মৌসুম ধরে সরকারের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে উৎপাদিত উদ্বৃত্ত লবণ এখনও মাঠে বা গুদামেই পড়ে আছে। এর ওপর সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বিদেশ থেকে বার বার লবণ আমদানি করায় লবণচাষিরা ন্যায্যমূল্য থেকে বার বার বঞ্চিত হয়েছেন। আর তাতেই আগ্রহ হারিয়েছেন লবণচাষে। লবণ উৎপাদন শিল্পে চাষি, শ্রমিকসহ জড়িত অন্তত ১০ লাখ মানুষ শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপের প্রত্যাশা করছে।

ইতোমধ্যে লবণ উৎপাদনের মওসুমের অনেকটা সময় কেটে গেছে। এরই মধ্যে লবণ নীতিমালা ঘোষণার পর মাঠে নামতে শুরু করেছেন চাষিরা। তবে অনেক চাষির মাঝে হতাশা ভর করেছে। কখন আবার লবণের ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন এই আশঙ্কায় শঙ্কিত তারা। কক্সবাজারের সাত উপজেলা চকরিয়া, পেকুয়া, টেকনাফ, কক্সবাজার সদর, রামু, কুতুবদিয়া, মহেশখালীসহ চট্টগ্রামের বাঁশখালীর ৫৫ হাজার লবণ চাষির পাশপাশি এখাতে জড়িত ১০ লাখ মানুষের আয়ের একমাত্র উৎস লবণ চাষ। সে কারণেই তারা লবণের ন্যায্যমূল্য প্রদানের মাধ্যমে খাতটিকে বাঁচিয়ে রাখতে রাখতে খোদ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বাঁশখালি উপজেলায় প্রান্তিক পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি উৎপাদন মৌসুমে এখনো খালি পড়ে আছে লবণ উৎপাদনের বিপুল পরিমাণ জমি। শুরুর দিকে কোনো কোনো উপজেলায় চাষিরা মাঠে নেমে লবণ উৎপাদন শুরু করলেও তাদের সংখ্যা ছিল নগণ্য। তবে সম্প্রতি লবণ চাষের পরিধি বাড়তে শুরু করেছে।

আরও পড়ুনঃ  দেশের উন্নয়নের স্বার্থে সরকার কাউকেই পরোয়া করে না 

বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বর্তমান বাজারে আয়োডাইজ মিশ্রিত লবণ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩০-৪০ টাকা দরে। অথচ সিন্ডিকেটের কারণে কয়েক বছর ধরে মাঠপর্যায়ে এক কেজি লবণের দাম মাত্র ৪ টাকাতে নেমে এসেছিল। এতে সিন্ডিকেটের পকেটে লাভ ঢুকলেও ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিলেন চাষিরা। অথচ মাঠ থেকে এক কেজি লবণ উৎপাদনে খরচ পড়েছিল সাড়ে ৬ টাকা।

এর আগে ২০১৭ সালে সরকার ‘বাফার স্টক’ গড়ে তোলার জন্য জাতীয় লবণনীতি-২০১৬-এর আলোকে পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিলেও এতদিন তা কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাই লবণ চাষিদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব হচ্ছিল না। তবে চলতি বছর ওই নীতিমালা চূড়ান্ত করে আইনে রূপ দেয়ায় লবণচাষিদের মনে অনেকটা আশার সঞ্চার হয়েছে।

কক্সবাজারের চকরিয়ার খুটাখালী ও ডুলাহাজারা ইউনিয়নের ৭৮২ দ্রোনের বড় লবণমাঠ বহলতলী ঘোনায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তা থাকায় মৌসুম শুরুর পর পরই মাঠে নামতে আগ্রহ ছিল না চাষিদের। তবে স্থানীয়রা বলছেন, আশায় বুক বেঁধে অনেকেই এখন মাঠে নেমে লবণ উৎপাদন শুরু করছেন।

চকরিয়ার বহলতলী ঘোনার একাধিক লবণ চাষি বলেন, গত কয়েকবছরে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় খালি পড়ে ছিল লবণ মাঠ। তার ওপর সিন্ডিকেট করে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি অব্যাহত থাকায় বহলতলী ঘোনার বড় লবণ মাঠে মৌসুমের শুরুতে কোনো চাষিকে মাঠে নামতে দেখা যায়নি। তবে দেশীয় শিল্প বাঁচানোসহ চাষিদের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার বিষয়ে জাতীয় লবণ নীতিমালা ঘোষণা করায় তারা এবার নতুন করে আশায় বুক বাঁধছেন। তারপরও শঙ্কা কাটছে না অনেকের।

আরও পড়ুনঃ  জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারের নজর নেই

লবণ চাষী সংগ্রাম কমিটির সভাপতি মোর্শেদুর রহমান জানান, এক কানি বা ৪০ শতক জমিতে লবণ উৎপাদনে খরচ হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা। অথচ লবণ চাষীরা পাচ্ছেন ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকার মতো। এছাড়া প্রতিমণ লবণ উৎপাদনে খরচ হচ্ছে ৩০০ টাকা করে। অথচ বিগত মৌসুমে তা বিক্রি করতে হয়েছে ১৫০ থেকে ১৭০ টাকায়। মোর্শেদুর রহমান আরো জানান, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে মণ প্রতি লবণের দাম ছিল ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। পরের অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় চারশ থেকে সাড়ে চারশ টাকায়। পরের অর্থবছরে তা আরো কমে গিয়ে হয় ১৭০ টাকা থেকে ১৬০ টাকা। সে সময় মাঠে মণ প্রতি লবণ উৎপাদনে খরচ ছিল ৩শ টাকা।

গেল কয়েক অর্থবছরে বার বারই লবণ চাষদের লোকসান গুণতে হয়েছে। আর এভাবে মার খেয়ে খেয়ে তাদের অনেকে লবণ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এমন প্রবণতা অব্যাহত থাকলে লবণচাষিদের চেয়ে বড় ক্ষতি হবে দেশের। এমনটাই মনে করছেন চাষিরা। তাই তারা সরকারের বিশেষ সহায়তা কামনা করছেন।

কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার মগনামা এলাকার লবণ চাষী ফরিদুল আলম বলেন, মণ প্রতি পাঁচশ টাকার লবণ ১৫০ টাকায় নেমে আসায় খুব কষ্টে আছি। ঋণ নিয়ে লবণ চাষ শুরু করেছিলাম। এখনো ঋণ শোধ করতে পারিনি। ফরিদুলের মতে, এমন ঘটনার জন্য দায়ি পটিয়া ও নারায়গঞ্জের কিছু অসাধু মিল মালিক। যারা সিন্ডিকেট করে লবণের দাম কমিয়ে ফেলেছে। আর চাহিদা পূর্ণ থাকার পরেও বেশি লাভের আশায় বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করে দেশি লবণের সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছেন। তিনি চলতি লবণ মৌসুমে যাতে প্রান্তিক চাষিরা লবণের প্রকৃত মূল্য পান তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি দাবি জানান।

আরও পড়ুনঃ  নারায়ণগঞ্জ বিস্ফোরণ, তিতাসের ৮ কর্মকর্তা গ্রেফতার

চট্টগ্রাম লবণ চাষি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও লবণ ব্যবসায়ী হারুনুর রশিদ বলেন, সরকার জাতীয় লবণনীতিমালা করায় এবার চাষিদের মাঝে আশার সঞ্চার হয়েছে। দীর্ঘদিনের দাবি বাস্তবায়ন হওয়ায় আশা করছি এবারের উৎপাদিত লবণের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কক্সবাজার লবণ প্রকল্প কার্যালয় সূত্রমতে, চলতি ২০২১-২২ মৌসুমে দেশে লবণের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ২০ লাখ টন।

সংবাদটি শেয়ার করুন