শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নাব্যতা ফেরাতে কবে খনন

টাঙ্গাইলের নদীগুলো মরাখাল

সারাদেশের মতো টাঙ্গাইলের ওপর দিয়েও বয়ে গেছে বহু নদী। যমুনা-ধলেশ্বরীসহ বেশ কয়েকটি ছোট-বড় নদী। যমুনা নদী ভূঞাপুর, নাগরপুর, কালিহাতীর বুকে জায়গা পেয়েছে। খরস্রোতা যমুনার শাখা ধলেশ্বরী নদী কালীহাতি, নাগরপুর ও দেলদুয়ারের ওপর বইছে। ধলেশ্বরীর উপনদী এ্যালেংজানী দেলদুয়ারে বইছে। এ্যালেংজানীর শাখা নদী লৌহজং ও বংশাই দেলদুয়ার, মির্জাপুরে এবং বংশাই, লাঙ্গলিয়া, ঝিনাই ও মরাগাঙ্গি নদী বাসাইলের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। বংশাইয়ের কিছু অংশ প্রবাহিত হচ্ছে ঘাটাইল উপজেলার ওপর দিয়ে।

গোটা জেলার ওপর ছোট-বড় নদীগুলো জালের মতো বিছিয়ে আছে। তবে জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো ক্রমশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অবৈধভাবে নদীর পাড় দখল করে কোনো কোনো নদীর প্রশস্ততা কমিয়ে ফেলেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও ভেকু দিয়ে অপরিকল্পিতখভাবে মাটি কাটার ফলে নদীর গতিপথের যেমন পরিবর্তন হচ্ছে, তেমনি অতিমাত্রায় ভাঙনের সৃষ্টি হচ্ছে। নদী থেকে শাখা প্রশাখা বের হয়ে খালের সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে মূল নদীর গভীরতা কমার পাশাপাশি কমেছে এর খরস্রোত। এতে পানিশূন্য হয়ে নদীগুলো হারিয়ে ফেলেছে নাব্যতা।

এক সময়ের প্রমত্তা ধলেশ্বরী, লৌহজং ও এ্যালেংজানী ও বংশাই নদী এখন মরা খালে পরিণত। নাব্যতা হারানোয় ক্রমশ ধু-ধু বালুচরে পরিণত হচ্ছে। কোথাও কোথাও চাষাবাদ হচ্ছে। কোথাও বোরো আবাদ, কোথাও বোরোর বীজ বোনা হয়েছে। স্রোতহীনা নদীগুলোতে অগভীর নলকূপ স্থাপন করে এখন চাষ হচ্ছে আবাদী ফসল। অথচ এক সময় নদীগুলো দিয়ে চলাচল করতো বড় বড় নৌযান। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এ অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ও পণ্য আনা নেওয়ার জন্য এ নদীগুলোই ছিলো একমাত্র উপায়। কালের বিবর্তনে নতুন প্রজন্মের কাছে এক সময়ে খরস্রোতা নদীগুলো এখন শুধুই স্মৃতি।

আরও পড়ুনঃ  নরসিংদীতে শিশুদের ফুল-পাখিদের কোলাহল

সম্প্রতি যমুনায় পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় এ শাখা নদীগুলোতে তার প্রভাব পড়েছে। ধলেশ্বরী নদীটি স্রোতহীন হয়ে পড়ায় বর্ষায় নদী বুকে জমা হওয়া পলি ও বালি অপসারিত হচ্ছে না। ফলে প্রতিবছর জেগে উঠছে ছোট বড় চর। লৌহজং , এ্যালেংজানী ও বংশাই নদীর মুল স্রোতধারা মূখে টাঙ্গাইলের যুগনীতে স্লুইসগেট তৈরি করায় নদী তিনটি প্রায় বিলীনের পথে। যদিও এটি শহরকে রক্ষা করছে। খাল খনন কর্মসূচিতেই নদীগুলো ফিরিয়ে দিতে পারে আগের অবস্থা। পরিবেশ বিশ্লেষকরা বলছেন, নদীগুলো রক্ষায় খনন কর্মসূচি নেয়ার কথা থাকলেও বাস্তবায়নের দৃশ্য চোখে পড়ার মতো না। পাউবোর তথ্যমতে, প্রথম ধাপে প্রতিটি উপজেলায় একটি করে খাল খনন করা হয়েছে। শিগগিরই নদী খননে আসছে বড় প্রকল্প।

ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহসড়কের বঙ্গবন্ধু সেতুর অল্প কিছু দক্ষিণে যমুনার চরে দেখা যায় অস্থায়ী বসতবাড়ি নির্মাণ করেছে স্থানীয়রা। এসব ঘর-বাড়িতে থেকে স্থানীয়রা নদীর বুকে চাষাবাদ করে। বর্ষা এলে অস্থায়ী ঘর বাড়িগুলো পুণরায় সরিয়ে নেয়া হয়। বাসে-ট্রেনে সেতু পার হওয়ার সময় যাত্রীদের কারো চোখ এড়ায় না এসব বসত বাড়ি। নদীতে থাকবে পানি। থাকার কথা মাছ, শুশুক, কুমির। তবে এখন নদীর অনেক জায়গাতেই দেখা মিলছে বসতবাড়ি।

টাঙ্গাইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ আহসানুল বাসার বলেন, নদীর নাব্যতা হারিয়ে যাওয়ায় একটু বৃষ্টি হলেই অনাকাঙ্ক্ষিত বর্ষার সৃষ্টি হয়। ফলে অনেক ধরণের ফসল বিনষ্ট হয়। এছাড়া পর্যাপ্ত পলি ছড়িয়ে না পড়ায় ক্রমশ কৃষি জমি অনুর্বর হচ্ছে। কৃষিকে বাঁচাতে নদীর গভীরতা বাড়াতে হবে। এজন্য প্রতিটি নদী খনন করে গভীরতা বাড়ানো জরুরি।

আরও পড়ুনঃ  আম সংরক্ষণের নেই ব্যবস্থা

টাঙ্গাইল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ এমদাদুল হক বলেন, নদীর নাব্যতা হারানোর ফলে সব ধরণের মাছরে ঘাটতি পড়ছে। বিশেষ করে দেশীয় মাছের। নদীর নাব্যতা হারানো চলমান থাকলে মাছের পোনা বড় হতে না পেড়ে অধিকাংশ মাছ বিলুপ্ত হবে। তবে যমুনা-ধলেশ্বরীসহ বড় নদীগুলোতে বর্ষায় পর্যাপ্ত পানি থাকে। ওই সময় পানিতে মাছের ডিম বা পোনা আসে। তখন কারেন্ট জাল, ঘুনি ও চায়না জাল বন্ধ রাখতে পারলে অধিকাংশ মাছের প্রজাতি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। মৎসা বিভাগ এ ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে।

বিগত ২০১৬ সালে টাঙ্গাইলের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মাহবুব হোসেন ৭৬ কিলোমিটার দৈর্ঘের লৌহজং নদীর তিন কিলোমিটারের অবৈধ দখল চিহ্নিত করে দখলমুক্ত করতে নানা ধরণের উদ্যোগ নেন। এরপর আবার বেদখল হয়ে যায় নদীর দু’পাড়। ২০২০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসককে সঙ্গে নিয়ে পুণরায় উচ্ছেদ অভিযান কার্যক্রম পরিদর্শন করেন অতিরিক্ত সচিব ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মাহবুব হোসেন। উচ্ছেদ অভিযানের পর আবারও নদীর দুপাড় পুনঃবেদখলের পথে। নদীগুলো পুনরুদ্ধার ও খনন জরুরি বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

টাঙ্গাইলের পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সিরাজুল ইসলাম নদ-নদীর নব্যতা হারানোর কথা স্বীকার করে বলেন, ইতোমধ্যে প্রথম ধাপের খাল খনন শেষ হয়েছে। জেলার গোপলাপুর-ধনবাড়ী, মধুপুরের বৈরান নদী, নাগরপুরে নোয়াই নদী, মির্জাপুরে বহুড়া খাল, করটিয়ার সুন্দরী খাল ও ঘাটাইলে টোপ নদীসহ বেশ কটি নদী বা খাল খনন করা হয়েছে। তবে শিগগিরই প্রতিটি জেলায় ৫টি করে নদীর অংশ বা খাল খননের প্রকল্প আসবে। এসব নদী খনন হলে জীব বৈচিত্রের পরিবর্তন আসবে। কৃষি, মৎস্য ও জলবায়ুর ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

আরও পড়ুনঃ  এভারেস্ট কন্যা ওয়াসফিয়া করোনায় আক্রান্ত

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন