দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা একজন আর্জেন্টিনীয় ফুটবল কোচ সেইসাথে একজন ম্যানেজার এবং প্রাক্তন খেলোয়াড় ছিলেন। অনেক বিশেষজ্ঞ, ফুটবল সমালোচক, প্রাক্তন ও বর্তমান খেলোয়াড় এবং ফুটবল সমর্থক তাকে সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে গন্য করেন।তিনি ফিফার বিংশ শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়ে পেলের সাথে যৌথভাবে ছিলেন।
পূর্ণ নাম-দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা।
দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা জন্ম ৩০ অক্টোবর ১৯৬০,উচ্চতা
১.৬৫ মিটার (৫ ফুট ৫ ইঞ্চি) মৃত্যু-২৫ নভেম্বর ২০২০ (বয়স ৬০)
মাঠে ফুটবল যাদুকরের অবস্থান অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার, সেকেন্ড স্ট্রাইকার হিসেবে।
যুব পর্যায়১৯৬৮–১৯৬৯,
এস্ত্রেয়া রোজা ১৯৭০–১৯৭৪,
লস কেবোইতাস ১৯৭৫–১৯৭৬,
আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স খেলেছেন।
জ্যেষ্ঠ পর্যায়*
১৯৭৬–১৯৮১
আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স-১৯৮১–১৯৮২
বোকা জুনিয়র্স-১৯৮২–১৯৮৪
বার্সেলোনা-১৯৮৪–১৯৯১
নাপোলি-১৯৯২–১৯৯৩
সেভিয়া-১৯৯৩–১৯৯৪
নিওয়েলস ওল্ড বয়েজ-১৯৯৪–১৯৯৭
বোকা জুনিয়র্স
যুব পর্যায় তার গোল সংখ্যা মোট-(২৫৮)টি।জাতীয় দলের হয়ে খেলেছে (১৯৭৭–১৯৯৪) আর্জেন্টিনাতে। মারাদোনাই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি দুইবার স্থানান্তর ফি এর ক্ষেত্র বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন। প্রথমবার বার্সেলোনায় স্থানান্তরের সময় ৫ মিলিয়ন ইউরো এবং দ্বিতীয়বার নাপোলিতে স্থানান্তরের সময় ৬.৯ মিলিয়ন ইউরো। নিজের পেশাদার ক্যারিয়ারে মারাদোনা আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স, বোকা জুনিয়র্স, বার্সেলোনা, নাপোলি, সেভিয়া এবং নিওয়েলস ওল্ড বয়েজের হয়ে খেলেছেন। ক্লাব পর্যায়ে তিনি তার নাপোলিতে কাটানো সময়ের জন্য বিখ্যাত, যেখানে তিনি অসংখ্য সম্মাননা জিতেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আর্জেন্টিনার হয়ে তিনি ৯১ খেলায় ৩৪ গোল করেন।
তিনি চারটি ফিফা বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। যার মধ্যে ছিল ১৯৮৬ বিশ্বকাপ, যেখানে তিনি আর্জেন্টিনা দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন এবং দলকে বিশ্বকাপ জয়ে নেতৃত্ব দেন। প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড় হিসেবে স্বর্ণগোলক জিতেন তিনি। প্রতিযোগিতার কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আর্জেন্টিনা ২–১ গোলে জয় লাভ করে। আর্জেন্টিনার পক্ষে উভয় গোলই করেন মারাদোনা। দুইটি গোলই ফুটবল ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে দুইটি ভিন্ন কারণে। প্রথম গোলটি ছিল হ্যান্ডবল যা “হ্যান্ড অফ গড” নামে খ্যাত। দ্বিতীয় গোলটি মারাদোনা প্রায় ৬০ মিটার দূর থেকে ড্রিবলিং করে পাঁচজন ইংরেজ ডিফেন্ডারকে পাশ কাটিয়ে করেন। ২০০২ সালে ফিফাডটকম এর ভোটাররা গোলটিকে শতাব্দীর সেরা গোল হিসাবে নির্বাচিত করে।
মারাদোনাকে ক্রীড়া জগতের সবচেয়ে বিতর্কিত এবং সংবাদ হিসেবে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গের অন্যতম মনে করা হয়। ১৯৯১ সালে ইতালিতে ড্রাগ টেস্টে কোকেইনের জন্য ধরা পড়ায় ১৫ মাসের জন্য ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ হন তিনি। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে ইফিড্রিন টেস্টে ইতিবাচক ফলাফলের জন্য তাকে প্রতিযোগিতা থেকে বাদ দেওয়া হয়। ২০০৫ সালে তিনি তার কোকেইন নেশা ত্যাগ করেন। তার কড়া রীতি মাঝেমাঝে সাংবাদিক এবং ক্রীড়া সংশ্লিষ্টদের সাথে তার মতভেদের সৃষ্টি করে। ম্যানেজার হিসেবে খুব কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও ২০০৮ সালের নভেম্বরে তাকে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১০ বিশ্বকাপের পর চুক্তি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি আঠারো মাস এই দায়িত্বে ছিলেন।
মারাদোনার বাবার নাম দিয়েগো মারাদোনা সিনিয়র এবং মা’র নাম দালমা সালভাদর ফ্রাঙ্কো। ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত মারাদোনা কোকেইনের প্রতি আসক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৮৩ সালে বার্সেলোনায় থাকার সময় থেকে মাদক ব্যবহার শুরু করেন। নাপোলিতে খেলার সময় তিনি নিয়মিত মাদক ব্যবহার করতে শুরু করেন। যা তার ফুটবল দক্ষতায় হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে। দিনের পর দিন তার শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। ২০০০ সালের ৪ জানুয়ারি, উরুগুয়ের পুন্তা দেল এস্তে-এ ছুটি কাটানোর সময় তাকে দ্রুত একটি স্থানীয় ক্লিনিকের জরুরি কক্ষে নেয়া হয়। একটি সংবাদ সম্মেলনে চিকিত্সকগণ বিবৃত করেন যে তার হৃৎপিণ্ডের পেশিতে ক্ষতি ধরা পড়েছে। পরবর্তীতে জানা যায় যে তার রক্তে কোকেইন পাওয়া গেছে এবং মারাদোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে পুলিশের কাছে ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে। এই ঘটনার পর তিনি মাদক পুনর্বাসন পরিকল্পনা অনুসরণের জন্য আর্জেন্টিনা ছেড়ে কিউবাতে চলে যান।
২০০৪ সালের ১৮ এপ্রিল, চিকিত্সকগণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেন যে অতিরিক্ত কোকেইন সেবনের কারণে মারাদোনা মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশনের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। বুয়েনোস আইরেসের একটি হাসপাতালে তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। তার অসংখ্য ভক্ত ক্লিনিকের চারপাশে ভিড় করে। ২৩ এপ্রিল তার শ্বাসযন্ত্র খুলে দেওয়া হয়, তবুও ২৯ এপ্রিল মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। তিনি কিউবায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেন, তবে তার পরিবার এর বিরোধিতা করে, তার আইনি অবিভাবকত্ব পরীক্ষা করার জন্য একটি বিচার বিভাগীয় পিটিশন দায়ের করা হয়।
মারাদোনার ওজন বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতা ছিল। তার খেলুড়ে ক্যারিয়ারের শেষ থেকে গ্যাস্ট্রিক বাইপাস সার্জারি করার আগ পর্যন্ত তিনি বৃদ্ধিমূলক স্থূলতায় ভুগছিলেন। ২০০৫ সালের ৬ মার্চ কলম্বিয়ায় তার অস্ত্রোপচার করা হয়। তার সার্জন বলেন যে মারাদোনাকে এক ধরনের তরল ডায়েট অনুসরণ করে চলতে হবে, তার স্বাভাবিক ওজন ফিরে পাওয়ার জন্য।যখন মারাদোনা জনসমক্ষে আসতে শুরু করেন, তখন তাকে আগের চেয়ে পাতলা গড়নে দেখা যায়। ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ, মারাদোনা পুনরায় বুয়েনোস আইরেসে একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাকে হেপাটাইটিস এবং অ্যালকোহলের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে চিকিত্সা করা হয়। তাকে ১১ এপ্রিল হাসপাতাল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়, কিন্তু এর দুই দিন পরই আবার ভর্তি হন। এর পরবর্তী কিছু দিনে তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে কিছু গুজব ছড়িয়ে পড়ে, এমনকি একই মাসে তিনবার তার মৃত্যুর গুজব ছড়ায়।
অ্যালকোহলসম্পর্কিত সমস্যার কারণে একটি মানসিক ক্লিনিকে স্থানান্তরের পর তাকে ৭ মে মুক্তি দেওয়া হয়।ক্লাব সম্পাদনা ঘরোয়া ফুটবল প্রতিযোগিতায় প্রতি খেলায় তার গোল করার গড় পরিমাণ ০.৫২৬। ১৬টি খেলায় জাতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে মাঠে নেমেছেন, যা একটি বিশ্বকাপ-রেকর্ড। বিশ্বকাপের ২১টি খেলায় ৮টি গোল করেন এবং অন্য ৮টি গোলে সহায়তা করেন। যার মধ্যে ১৯৮৬ বিশ্বকাপে করেন ৫টি গোল এবং ৫টি সহায়তা।
নিজেস্ব অর্জন-
আর্জেন্টিনীয় প্রিমেরা ডিভিশনের শীর্ষ গোলদাতা।
মেত্রোপলিতানো ১৯৭৮, ১৯৭৯
ন্যাসিওনাল ১৯৭৯, ১৯৮০
ফিফা বিশ্ব যুব চ্যাম্পিয়নশিপ গোল্ডেন বল: ১৯৭৯
ফিফা বিশ্ব যুব চ্যাম্পিয়নশিপ সিলভার শু: ১৯৭৯
বর্ষসেরা খেলোয়াড় (গুয়েরিন স্পোর্তিভো): ১৯৭৯
আর্জেন্টিনার বর্ষসেরা ফুটবলার : ১৯৭৯, ১৯৮০, ১৯৮১, ১৯৮৬
দক্ষিণ আমেরিকান বর্ষসেরা ফুটবলার : (অফিসিয়াল পুরস্কার) ১৯৭৯, ১৯৮০
অলিম্পিয়া দি অরো : ১৯৭৯, ১৯৮৬
গুয়েরিন দ’অরো (সিরি এ বর্ষসেরা ফুটবলার): ১৯৮৫
অঞ্জে দি ব্রোঞ্জ : ১৯৮৫, ১৯৮৮
ফিফা বিশ্বকাপ গোল্ডেন বল: ১৯৮৬
ফিফা বিশ্বকাপ সিলভার বুট: ১৯৮৬
ফিফা বিশ্বকাপ সর্বোচ্চ সহায়তা: ১৯৮৬
ফিফা বিশ্বকাপ অল-স্টার দল (২): ১৯৮৬, ১৯৯০
অঞ্জে দ’অর : ১৯৮৬, ১৯৮৭
আর্জেন্টাইন স্পোর্টস রাইটার্স বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ: ১৯৮৬
এল’ইকুইপ চ্যাম্পিয়ন অফ চ্যাম্পিয়নস: ১৯৮৬
ইউনাইটেড প্রেস আন্তর্জাতিক বর্ষসেরা অ্যাথলেট পুরস্কার: ১৯৮৬
ওয়ার্ল্ড সকার পুরস্কার বর্ষসেরা ফুটবলার: ১৯৮৬
দক্ষিণ আমেরিকান বর্ষসেরা খেলোয়াড় (৪): (অফিসিয়াল পুরস্কার নয়) ১৯৮৬, ১৯৮৯, ১৯৯০, ১৯৯২
ক্যাপোক্যানোনিয়েরে (সিরি এ সর্বোচ্চ গোলদাতা): ১৯৮৭–৮৮
কোপা ইতালিয়া সর্বোচ্চ গোলদাতা: ১৯৮৭–৮৮
ফিফা বিশ্বকাপ ব্রোঞ্জ বল: ১৯৯০
অঞ্জে দ’অর (ফরাসি সংবাদপত্র অঞ্জে মন্দিয়াল বর্ষসেরা খেলোয়াড়): ১৯৯৪
ফিফা বিশ্বকাপ অল-টাইম দল: ১৯৯৪
মার্কা লেইয়েন্দা: ১৯৯৯
বিংশ শতাব্দির সেরা দল: ১৯৯৮
ওয়ার্ল্ড সকার বিংশ শতাব্দির সেরা খেলোয়াড়গন: ১৯৯৯
ফিফা শতাব্দির সেরা খেলোয়াড়: ২০০০
ফিফা বিশ্বকাপ শতাব্দির সেরা গোল (১৯৮৬ (২–১) ইংল্যান্ডের বিপক্ষে; দ্বিতীয় গোল): ২০০২
ফিফা বিশ্বকাপ ড্রিম টিম: ২০০২
ফিফা ১০০ জীবিত ফুটবলার: ২০০৪
ওয়ার্ল্ড সকার সর্বকালের সেরা একাদশ: ২০১৩
নাপোলি সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা
ফুটবল সেবার জন্য গোল্ডেন বল (ফ্রান্স ফুটবল): ১৯৯৬
আর্জেন্টাইন স্পোর্টস রাইটার্স শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদ: ১৯৯৯
আর্জেন্টিনীয় সিনেট “দমিনগো ফাউস্তিনো সারমিয়েন্তো” জীবনকাল কৃতিত্বের জন্য স্বীকৃতি: ২০০৫।
বর্তমান খেলোয়াড় এবং ফুটবল সমর্থক তাকে সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে গন্য করেন, চিরকাল বেঁচে থাকবেন এই কিংবদন্তি তার ভালোবাসার ফুটবলপ্রেমী মানুষগুলোর কাছে।
আনন্দবাজার/শাহী/কবীর