ঢাকা | শুক্রবার
২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লক্ষ্মীপুরের পর্যটন ছড়াচ্ছে মুগ্ধতা

লক্ষ্মীপুরের পর্যটন ছড়াচ্ছে মুগ্ধতা

প্রকৃতির চিরচেনা দৃশ্যপট মেঘনার রূপ, রস ও সৌন্দর্যে ভরপুর মেঘনা পাড়ের উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর। সবুজ শ্যামল প্রকৃতি আর মনভোলানো জলরাশি এই দুইয়ে মিলে মেঘনা পাড়ের উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরকে গড়ে তুলেছে অপরূপ এক ছবির শহর । ফলে এই উপকূল পরিনত হয়েছে প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের বিনোদনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে। উপকূলীয় এ জেলায় রয়েছে নদীর বুক ছিড়ে জেগে ওঠা অসংখ্য চর, মিঠাপানির প্রবাহের সাথে নীল আকাশের মিতালী। ইলিশের দীর্ঘতম অভয়াশ্রম এ উপকূলকে করেছে আরো সমৃদ্ধ। প্রতিদিন মেঘনার বুকের উপর ভর করে পণ্যবহনকারী সারিবাঁধা লাইটারেজ কন্টেইনার , ছোট-বড় মাছ ধরা, পালতোলা নৌকার দৃশ্য আর পাড় ঘেঁষা নারকেল-সুপারির সাজানো বাগান মুহুর্তেই জুড়িয়ে দিতে পারে পর্যটক হৃদয়।

উপকূলের মনোমুগ্ধকর জনপদের মধ্যে অন্যতম সম্ভাবনাময় পর্যটন এলাকা হচ্ছে মতিরহাট মেঘনা সৈকত। এটির অবস্থান লক্ষ্মীপুরের কমলনগরে। মতিরহাট বাজারের উত্তর-দক্ষিণ দিকে মেঘনার পানির সাথে জড়িয়ে একাকার এ সৈকত। স্থানীয় বাসিন্দারা এটির নাম দিয়েছে মিনি কক্সবাজার। মনভোলানো বিশাল জলরাশি। উন্মুক্ত আকাশে মেঘের আল্পনায় ক্ষণে ক্ষণে রং বদলের খেলা। আকাশের নীলিমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিচে নদীর রঙ বদলায়। কূলে দাঁড়িয়ে আকাশ এবং নদীর এমন মোহনীয় মিতালীর দৃশ্য ভ্রমণপিয়াসীদের মনকে আন্দেলিত করে। পড়ন্ত বিকেলে ক্লান্ত সূর্যটা যখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ে তখন সূর্যের মায়াবী রশ্মি মেঘনার জলে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। মেঘনার জলে চোখ রাখলেই তখন ঝিলমিল আরেকটা সূর্যের দেখা মিলে। অস্তগামী সূর্যরশ্মির সঙ্গে জোয়ার-ভাটার মনোমুগ্ধকর খেলা পর্যটকদের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

বর্ষা কালে নদীর হৃদয় থেকে তৈরি হওয়া ঢেউগুলো অবিরাম আছড়ে পড়ে সৈকতের বুকে। ঢেউয়ের পানিতে পা ভিজিয়ে হাঁটেন সৌন্দযৃপিপাসু পর্যটকদের দল। অনেকে আবার নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ান মেঘনায়। ঢেউয়ের তালে দোল খেতে খেতে মেতে ওঠেন ভ্রমণ আনন্দে। ভাসতে ভাসতে তাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে রূপালি ইলিশ শিকারে ব্যস্ত জেলেদের সারি সারি নৌকো।

একযুগ আগেও এখানে চলছিল মেঘনার ভয়াবহ ভাঙন। উন্মত্ত মেঘনার ভাঙনরোধে নির্মাণ করা হয় বেড়িবাঁধ। ফলে, ভাঙন বন্ধ হয়ে দক্ষিণে প্রায় আধ কিলোমিটার এবং উত্তরে দেড় কিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিশাল বেলাভূমির সৃষ্টি হয়। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এই বেলাভূমি ধীরে ধীরে পরিণত হয় জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রে। শুধু বেলাভূমি নয়, বেড়িবাঁধের উপর দাঁড়ালে মেঘনার খোলা বাতাস মনকে সিক্ত করে। যতদূর চোখ যায়, কেবল থৈ থৈ জলরাশি। আর জনপ্রিয় এই পর্যটনকেন্দ্রে প্রতিনিয়ত আগমন ঘটে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের।

মেঘনাপাড়ের প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্য পর্যটকদের মুগ্ধ করার পাশাপাশি লক্ষ্মীপুরে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে আরো দুটি পর্যটন কেন্দ্র। তার মধ্যে একটি হচ্ছে আলতাফ মাষ্টার ঘাট। এটিও মেঘনা তীরের একটি পর্যটন স্পট। এটির অবস্থান জেলার রায়পুর উপজেলার রায়পুর পশ্চিমাঞ্চলে। মেঘনাপাড়ের এই পর্যটন কেন্দ্রটিতে রয়েছে ছোটো বড় অন্তত ২০টি দোকান-রেস্তোরা। প্রতিদিন প্রায় দুইশতাধীকেরও অধিক পর্যটকদের সমাগম মুখরিত থাকে এই পর্যটন কেন্দ্রটি।

আলতাফ মাষ্টার ঘাটের পরেই আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে আছে খোয়া সাগর দীঘি পর্যটন কেন্দ্র। চারপাশে সবুজের সমারোহ, গাছগাছালির অপরুপ মিতালী। পাড় ঘেঁসে লক্ষ্মীপুরের লক্ষ্মী ফসল সুপারির বাগান। এর মাঝেই অবস্থান নয়নাভিরাম খোয়াসাগর দীঘির। দুপুরের তপ্ত রোধে পানির ঝলকানি আর বিকেলের পর্যটক সমাগমে মুখরিত থাকে লক্ষ্মীপুরের দালাল বাজারস্থ এই পর্যটন স্পট।

রায়পুর-লক্ষ্মীপুর মহাসড়কের পাশের এই দীঘির দুরত্ব জেলা শহর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আঁধার নয়নাভিরাম এই দীঘিটি দেখতে প্রায় প্রতিদিনই ভীড় জমান অন্তত পাঁচ সহস্রাধিক পর্যটক। ঈদ কিংবা ছুটির দিনে এই সংখ্যা থাকে উল্লেখিত সংখ্যার কয়েকগুন বেশি।

দীঘিটি বিগত এক দশকে পর্যটকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও এটির ইতিহাস সুপ্রাচীন। আজ থেকে প্রায় ২শ পঞ্চাশ বছরের পুরোনো এই দিঘি দালাল বাজার এলাকার জমিদার ব্রজবল্লভ রায় স্থানীয় মানুষের বিশুদ্ধ পানির চাহিদা মেটাতে ১৭৭৫ সালের দিকে দিঘীটি খনন করেন। খনন কাজের পর পালকি যোগে এক নববধূ দিঘীটির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। গন্তব্য দূরে হওয়ায় এই দিঘির পানি পান করে সেই নব বধূ নিজেন তৃষ্ণা মেটাতে চেয়েছিলেন। সে সুবাদে পালকিবাহকদের বলে নব বধূ পালকি থেকে নেমে পানি পানের উদ্দেশ্যে দিঘির পাড়ে যান। পরে ঘন কুয়াশায় তাকে দেখা না গেলে স্বজন ও পালকিবাহকরা দেখতে গেলে সেখানে পাওয়া যায়নি তাকে। অবশ্য কিছুটা ভৌতিক সেই ঐতিহাসিক ঘটনার চর্চা বন্ধ হয়নি এ যুগেও। সে নব বধূর হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা লোকমূখে চর্চিত হলেও শেষ পর্যন্ত তার পরিনতি কি হয়েছিলো তা বলতে পারেন না কেউই।

ইতিহাস বিজড়িত এই দীঘি নিয়ে লোকমুখে রয়েছে নানান সব গল্প। এর নামকরণেও রয়েছে যুক্তিপূর্ণ একটি ইতিহাস। প্রায় ২২ একর জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা দীঘির একপাশ থেকে আরেকপাশ পরিষ্কার দেখা যায় না। এক দৃষ্টিতে তাকালে মনে হয়, দীঘিটি যেন কুয়াশাচ্ছন্ন। লক্ষ্মীপুরে স্থানীয় ভাষায় কুয়াশাকে ‘খোয়া’ বলা হয়। আবার এই দীঘির আকৃতি এবং পানির মনোমুগ্ধকর দৃশ্যকে সাগরের পানির সাথে তুলনা করে স্থানীয়রা। মূলত এ দুটি যুক্তিতেই দীঘিটিকে ‘খোয়াসাগর’ দীঘি বলে ডাকা হয়। দীঘির দুই পাড়ে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্টসহ বাহারি সব খাবারের দোকান। রয়েছে শিল্পাঙ্গন নামে একটি মিনি পার্টি স্পটও। দীঘিতে ঘুরে বেড়ানোর জন্য রয়েছে দুটি সাধারন ও হাঁস সদৃশ প্রায় চারটি নৌকো। নির্দিষ্ট পরিমান অর্থের বিনিময়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পর্যটকরা সেগুলোয় চড়তে পারেন। অনিন্দ্য সুন্দর দীঘিটির এক পাশে জেলা প্রশাসক লক্ষ্মীপুরের উদ্যোগে সংস্কার কাজ করায় এটির সৌন্দর্য বহুগুণে বেড়েছে। ফলে আগের তুলনায় আনুপাতিক হারে বাড়ছে পর্যটক সমাগমও। উল্লেখিত পর্যটন কেন্দ্রগুলো ছাড়াও জেলায় অবস্থিত ছোট-বড় বেশ কয়েকটি পর্যটন স্পট রয়েছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন