- ‘ওরা আমাদের মতোই পাগল’
- আর্জেন্টিনার গণমাধ্যমে বাংলাদেশি ভক্তরা
দীর্ঘ ৩৬ বছর অপেক্ষার অবসান। তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জয়ে আবারও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন খেতাব পেলো দক্ষিণ মেসির আর্জেন্টিনা। আনন্দে ভাসলো দেশটির ফুটবল ভক্তরা। মেসিদের এই সাফল্য ব্যাপকভাবে ছুঁয়ে গেছে বাংলাদেশেও। নেচে গেয়ে বিশ্বকাপ জয় উদযাপন করেছে বাংলাদেশি ফুটবল ভক্তরা। টাইগার অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও প্রিয় দলের শিরোপা জয়ের রাতে রাস্তায় নেমে উদযাপন করেন। রাত ১টার কাছাকাছি সময়ে সাকিব প্রাইভেটকারে করে বের হয়ে পড়েন চট্টগ্রামের রাস্তায়। বাংলাদেশি ভক্তদের এমন পাগলামী আগেই পৌঁছে গিয়েছিলো আর্জেন্টিনায়। যা দেখে আর্জেন্টিনার জাতীয় ফুটবল দলের অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্টে বাংলাদেশকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছিলো ‘ওরা আমাদের মতোই পাগল’।
বাংলাদেশের মেসি ভক্তদের উচ্ছ্বাস-উন্মাদনা নিয়ে গত সোমবার সংবাদ প্রকাশ করেছে আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যম বুয়েনস আইরেস টাইমস। বার্তাসংস্থা এএফপির বরাতে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, রবিবার বিশ্বকাপের ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার জয় উদযাপনে মাতেন অর্ধ পৃথিবী দূরে অবস্থিত বাংলাদেশের সমর্থকরা। এসময় মেসির বিশ্বজয়ের আনন্দে শীতের ঠাণ্ডার মধ্যেও বাংলাদেশি ফুটবল ভক্তরা ‘মেসি, মেসি’ বলে স্লোগান দেন এবং রাস্তায় আনন্দের অশ্রু ঝরিয়ে নাচতে থাকেন। পুলিশের বরাত দিয়ে এতে বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ নানা চত্বর, রাস্তা এবং ফুটবল মাঠে স্থাপন করা বিশালাকার পর্দায় ফাইনাল ম্যাচটি দেখতে কয়েক হাজার মানুষ ঠান্ডা তাপমাত্রাকে উপেক্ষা করেই জড়ো হয়েছিলেন।
এসব ফুটবল ভক্তদের অনেকেই আর্জেন্টিনার আইকনিক নীল-সাদা জার্সি এবং লিওনেল মেসির আইকনিক ১০ নাম্বার জার্সি পরে খেলা দেখায় অংশ নেন। রবিবারের ফাইনাল ম্যাচ বড় পর্দায় দেখতে সবচেয়ে বেশি জনসমাগম হয়েছিল রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। এসময় অনেকে প্রিয় দলের খেলা দেখতে তাদের গালে আর্জেন্টিনার পতাকা এঁকেছিলেন। খেলার প্রথমার্ধে পেনাল্টি থেকে মেসি প্রথম গোলটি করলে দর্শকরা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন।
বাংলাদেশি ভক্তদের এমন ভালোবাসা চুয়ে গেছে আর্জেন্টিনার জনগণের মাঝেও। তাইতো তারাও এখন বাংলাদেশকে নিয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করেন। এই দেশকে নিয়ে আর্জেন্টিনাতে এখন মাতামাতি হয়। ক্রিকেট মাঠে বাংলাদেশের বিজয়ের খবর প্রচার করা হয় দেশটির গণমাধ্যমেও। বিশ্বকাপ জয়ের পরও বাংলাদেশের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে তারা। নিজেদের ভেরিফায়েড টুইটার অ্যাকাউন্টে আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারশন লিখেছে, ‘ধন্যবাদ বাংলাদেশ। আপনাদের সুন্দর সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ কেরালা, ভারত, পাকিস্তান।
এর আগে বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রতি পাল্টা সমর্থন দেখিয়ে সামাজিক মাধ্যমে পেজ খুলেছেন আর্জেন্টাইনদের অনেকে। বুয়েনেস আইরেসের খেলায় দর্শকের হাতে আর্জেন্টিনার পাশেই উড়ছিলো বাংলাদেশের পতাকা এবং টুইটার-ফেসবুকে শত শত আর্জেন্টাইনের প্রোফাইলে দেখা গিয়েছিলো বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকার ইমোজি।
আর্জেন্টিনার জাতীয় ফুটবল দলের অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্টে বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো পোস্ট। পয়লা ডিসেম্বর আর্জেন্টিনার বাংলাদেশি সমর্থকদের তিনটি ছবি দিয়ে ওই পোস্টটিতে লেখা হয়, “আমাদের সমর্থন দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।” এরপর লেখা হয়েছে, “ওরা আমাদের মতোই পাগল।” এখানেই শেষ নয়, এক প্রাক ম্যাচ সংবাদ সম্মেলনে ‘সমর্থনের জন্য’ বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন আর্জেন্টাইন কোচ লিওনেল স্কাকোনি। সর্বশেষ আমেরিকান ভিডিও লাইভ স্ট্রিম টুইচে সার্জিও অ্যাগুয়েরোর এক লাইভে, যেখানে মেসিও উপস্থিত হয়েছিলেন, সেখান থেকে তাদের বাংলাদেশি ভক্তদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, বলে খবর দিচ্ছে খেলাধুলা বিষয়ক বার্তা সংস্থা বিআর ফুটবল।
এর আগে, বাংলাদেশে মেসি ভক্তদের উন্মাদনার খবর শুনে বিশ্বকাপের মধ্যেই বাংলাদেশিদের দারুণ উপহার দিয়েছিল আর্জেন্টিনা। মেসির হাতে বাংলাদেশের পতাকা যুক্ত একটি ছবি পোস্ট করা হয়েছিল আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন প্রফেশনাল ফুটবল লিগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে। একই ছবি শেয়ার করা হয় প্রফেশনাল লিগের ভেরিফায়েড টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকেও। এতে দেখা যায়, আর্জেন্টিনার জার্সি পরা উল্লাসিত মেসি মাঠের মধ্যে বাংলাদেশের পতাকা হাতে ছুটছেন। যদিও দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, সম্পাদনা (এডিট) করে ছবিতে বাংলাদেশের পতাকা যোগ করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশিদের সম্মান জানাতেই এ কাজটি করেছিল খোদ আর্জেন্টাইন ফুটবল ফেডারেশন।
আবার, চলতি মাসের শুরুর দিকে ওয়ানডে সিরিজে ভারতকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল। টাইগারদের ওই জয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন বহু আর্জেন্টাইন। এ নিয়ে প্রতিবেদন করে আর্জেন্টিনার গণমাধ্যমগুলোও। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্টের পোস্ট ভরে যায় আর্জেন্টাইনদের মন্তব্য। মন্তব্যে স্প্যানিশ ভাষার পাশাপাশি বাংলায় ‘আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি’ লেখা ছবি পোস্ট করেন অনেকে। বাংলাদেশ-আর্জেন্টিনার ভ্রাতৃত্বের প্রতীক হিসেবে করমর্দনের ছবিও পোস্ট করেছেন কেউ কেউ।
কাতার বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের কাছে অবিশ্বাস্য পরাজয়ের পর দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ায় মেসি বাহিনী। আর্জেন্টিনার প্রতিটি জয়ে বাংলাদেশের আর্জেন্টিনা ভক্তদের মনে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেছে। গভীর রাতেই রাস্তায় বেরিয়েছে মিছিল। বাংলাদেশি আর্জেন্টাইন ভক্তদের এই উল্লাসের আওয়াজ পৌঁছে গেছে বিশ্বফুটবলের প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা পর্যন্ত। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের আর্জেন্টিনা সমর্থকদের উল্লাসের ভিডিও শেয়ার করেছে। এবার আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশনের ধন্যবাদও কুড়িয়ে নিল বাংলাদেশের আর্জেন্টিনা সমর্থকরা।
ফ্রান্সের বিপক্ষে রবিবারের নাটকীয় বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনা প্রথমার্ধে ২-০ তে এগিয়ে থাকলেও দ্বিতীয়ার্ধে দুই মিনিটে দুটি গোল হজম করে। অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে মেসি গোল করলেও পরে পেনাল্টি কিক দিয়ে স্কোরে আবারও সমতা ফেরান এমবাপে। শেষ পর্যন্ত পেনাল্টি শুটআউটে ফ্রান্সকে ৪-২ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপ জয় করে আর্জেন্টিনা। আর এর মাধ্যমে ১৯৭৮ এবং ১৯৮৬ সালের পর তৃতীয়বার বিশ্বকাপ ঘরে তুলল আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনার হয়ে দু’টি গোল করেন ৩৫ বছর বয়সী মেসি, অপরটি করেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। অন্যদিকে ২৩ বছর বয়সী কিলিয়ান এমবাপ্পে এদিন ফ্রান্সের একমাত্র স্কোরার হিসেবে তিনটি গোল করেন।
বাংলাদেশে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশ বেড়েছে। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, বাড়ির ওপর পছন্দের দলের জাতীয় পতাকা টাঙাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এবং ছাদ থেকে পড়ে অন্তত সাতজন লোক মারা গেছেন। এছাড়া গ্রামীণ শহরগুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বী ফুটবল সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত তিনজন মারা গেছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে।
এর আগে বাংলাদেশের ফুটবল সমর্থকদের আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল মাতামাতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। এতে ব্রাজিল-আর্জন্টিনা নিয়ে বিশ্বের অষ্টম সর্বোচ্চ জনবহুল দেশ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক, বিশাল বিশাল পতাকা টাঙানো, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকার রঙে বাড়ির বারান্দা, সেতু রাঙানোর বিষয়ও তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও থেকে বাংলাদেশের দূরত্ব ৯ হাজার ৫০৩ মাইল। অন্যদিকে আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসের দূরত্ব ১০ হাজার ৪২০ মাইল। তা সত্ত্বেও এ দুই দেশ নিয়ে বাংলাদেশে মাতামাতি ব্যাপক।
আনন্দবাজার/শহক