বিশ্ব এখন ভাসছে ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ খ্যাত ফুটবল বিশ্বকাপের জোয়ারে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে গোটা বিশ্বই যখন প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণে, তখন বিশ্বকাপ আয়োজনে নতুন নতুন প্রযুক্তির চমক থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই চোখ ধাঁধানো অনুষ্ঠানের আয়োজন আর অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে হাজির হয়েছে কাতার ২০২২-বিশ্বকাপ। এমন সব প্রযুক্তি যুক্ত হয়েছে যা আগে কখনো দেখেনি গোটা বিশ্ব। খেলোয়াড়দের ক্রীড়ানৈপুণ্যে, ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স, মানসিক স্বাস্থ্য, বিতর্কিত ও জটিল সিদ্ধান্তগুলো সঠিক ও নিখুঁতভাবে দ্রুত সময়ে পর্যবেক্ষণ করার জন্য যুক্ত হয়েছে মোবাইল অ্যাপস এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। নিচে তুলে ধরা হল এবারের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রযুক্তির কথা।
সেমি-অটোমেটেড অফসাইড
গত বছর আরব কাপ এবং ক্লাব বিশ্বকাপে আধা স্বয়ংক্রিয় অফসাইড প্রযুক্তি পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করেছে ফিফা। তবে বিশ্বকাপ আসরে এবারই প্রথম । এ প্রযুক্তিতে ভিডিও ম্যাচ কর্মকর্তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অফসাইডের তথ্য পান। এরপর মাঠের রেফারির সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে রেফারি যেহেতু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন, তাই এ প্রযুক্তিকে বলা হচ্ছে ‘আধা স্বয়ংক্রিয়’ পদ্ধতি।
আধুনিক এ প্রযুক্তির জন্য মাঠে একাধিক ক্যামেরা ও বলে বিশেষ সেন্সর ব্যবহার করা হয়েছে। বিশ্বকাপের প্রতিটি স্টেডিয়ামে ছাদের নিচে মোট ১২টি করে ক্যামেরা বসানো। ক্যামেরাগুলো মূলত মাঠে বলের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করবে। এ ছাড়া ক্যামেরার মাধ্যমে খেলোয়াড়দের শরীরের ২৯টি স্থানের অবস্থানও চিহ্নিত করে তাঁদের ত্রিমাত্রিক অবয়ব তৈরি করে এ প্রযুক্তি, যা বলের সঙ্গে খেলোয়াড়ের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত করবে। এসব বিশ্লেষণ করে রেফারির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশনের মাধ্যমে ঘটনার মুহূর্তটি মাঠের বড় পর্দায় দর্শকদের জন্য উপস্থাপন করে। আবার প্রতি সেকেন্ডে একেকজন খেলোয়াড়ের শারীরিক অবস্থানের ৫০টি করে তথ্য প্রদান করবে এ প্রযুক্তি। এতে বল ও খেলোয়াড়ের সঠিক অবস্থান নিশ্চিত করা যাবে।
এ প্রযুক্তির কার্যকারিতার প্রমাণ দেখতে আবারও আর্জেন্টিনা ও সৌদি আরব ম্যাচেই ফেরা যাক। ওই ম্যাচে প্রথমার্ধেই মেসির দল সাতটি অফসাইড করেছে। বলা হচ্ছে, প্রথমার্ধে এতগুলো অফসাইডের নজির আগে মেলেনি। ওই ম্যাচে আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকারের লাওতারো মার্তিনেজের দুটি গোল অফসাইডে বাতিল হয়ে যায়। এর মধ্যে একটিতে মার্তিনেজের বাঁ হাতের একটি অংশ অফসাইড জোনের মধ্যে চলে যায়। তৎক্ষণাৎ এটি সেমি-অটোমেটেড প্রযুক্তিতে ধরা পড়ে। এতেই বাতিল হয়ে যায় ওই গোল।
অত্যাধুনিক এ প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ থেকেই। স্বাগতিক কাতার বনাম ইকুয়েডরের ওই ম্যাচের প্রথম গোলই বাতিল হয়েছিল অফসাইড আইনে। এতে অনেকে ফুটবল-ভক্ত অবাক হয়েছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা বিতর্কের সৃষ্টিও হয়েছিল। অনেক নেটিজেনের দাবি, এত চুলচেরা বিশ্লেষণ খেলার স্বাভাবিক ছন্দে পতন ঘটাচ্ছে। তবে অফসাইডের ব্যাপারে কোনো বিতর্ক রাখতে চায় না ফিফা। তাই এ প্রযুক্তি ব্যবহারের সিদ্ধান্তের কথা ফিফা অনেক আগেই আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছিল।
বলের ভেতরে সেন্সর
বিশ্বকাপের অফিশিয়াল বলের নাম ‘আল-রিহলা’। বাংলায় এর অর্থ ‘ভ্রমণ’। ইবনে বতুতার ভ্রমণ আর জীবনের গল্প নিয়ে বই আল রিহলার নামের সঙ্গে মিল রেখেই এ বলের নাম রাখা হয়েছে। বরাবরের মতোই ক্রীড়াসামগ্রী প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান অ্যাডিডাস বিশ্বকাপের বল তৈরি করেছে। নকশার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত দিকেও এ বলে কোনো ছাড় দেয়নি ফিফা। এ বলের ভেতরে বসানো হয়েছে ইনার্শিয়াল মেজারমেন্ট ইউনিট (আইএমআই) সেন্সর। খুব অল্প ব্যবধানের অফসাইড কিংবা খালি চোখে ধরা পড়ে না, এমন অফসাইডগুলো এ সেন্সরে ধরা পড়ে। সেন্সরের ওই তথ্য তৎক্ষণাৎ পৌঁছে যায় ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির কাছে।
গোললাইন প্রযুক্তি
২০১৪ সাল থেকেই খেলায় গোললাইন প্রযুক্তির ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। এবারের বিশ্বকাপেও সেই ধারা অব্যাহত আছে। বল গোলপোস্টের নির্ধারিত রেখা অতিক্রম করেছে কি না, সেটা তৎক্ষণাৎ নিশ্চিত হওয়ার জন্য এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। গোললাইন প্রযুক্তির জন্য মাঠে ১৪টি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়। সেমি-অটোমেটেড অফসাইড প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত ক্যামেরার সঙ্গে গোললাইন প্রযুক্তির ক্যামেরার কোনো সম্পর্ক নেই। গোললাইন প্রযুক্তির ক্যামেরাগুলো স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে। বল গোলপোস্টের নির্ধারিত রেখা অতিক্রম করলেই তথ্যটি ম্যাচ অফিশিয়ালদের হাতের স্মার্টওয়াচে পৌঁছে যায় এ প্রযুক্তির মাধ্যমে। এতে মাঠের রেফারি দ্রুত সিদ্ধান্ত জানাতে পারেন। একই সঙ্গে ক্যামেরা থেকে পাওয়া তথ্য তৎক্ষণাৎ ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশনের মাধ্যমে মাঠের বড় পর্দায় ও টেলিভিশনের দর্শক দেখানো হয়।