ঢাকা | মঙ্গলবার
৭ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
২৩শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিএনপি নেতার মেয়ের সঙ্গে হাতিতে চড়ে ছাত্রলীগ নেতার রাজকীয় বিয়ে

ঝিনাইদহ প্রতিনিধিঃ হাতির পিঠে চড়ে রাজকীয় আয়োজনে বিয়ে করতে গেলেন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের এক নেতা। হাতে ছোট ছোরা, মাথায় পাগড়ি পরে বর চড়লেন হাতিতে,পেছনে ঘোড়ার গাড়ির টমটম, পালকি ও ব্যান্ডপার্টি সাথে শত শত বরযাত্রী। দেখে মনে হবে কোনো রাজকুমারের বিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো রাজকুমার নয় এমনই রাজকীয় বেশে বিয়ে করতে গেলেন নিষিদ্ধ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা শাওন। এই ঘটনাটি ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার নবগ্রামে। আর এই বিয়ের ঘটনায় রীতিমতো চারিদিকে আলোচনা-সমালোচনা ঝড় বইছে। হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা যেখানে পলাতক, সেখানে ওই ছাত্রলীগ নেতার রাজকীয় বিয়ে নিয়ে সবার চোখ যেন কপালে উঠে গেছে। অনেকে তার পরিবারের আয়ের উৎস অনুসন্ধানের দাবি জানিয়েছেন। সদ্য বিবাহিত ওই ছাত্রলীগ নেতার নাম নিশান আহমেদ শাওন (১৮)। তিনি ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলা ছাত্রলীগ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক। তার দাদা আব্দুল মান্নান বিশ্বাস উপজেলার সারুটিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুল মান্নান বিশ্বাস দীর্ঘদিন ধরে ওই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। নিশান উপজেলা ছাত্রলীগের ২০২২ সালের ঘোষিত সর্বশেষ কমিটির ৭ নং সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি প্রয়াত সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাইয়ের অনুসারী ছিলেন বলে জানা গেছে।

জানা যায়, নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা নিশান আহমেদ শাওন শৈলকুপা উপজেলার সারুটিয়া ইউনিয়নের নবগ্রাম গ্রামের ফারুক বিশ্বাসের একমাত্র পুত্র সন্তান। একই গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য ও স্থানীয় বিএনপির নেতা জাহাঙ্গীর আলমের কলেজ পড়ুয়া মেয়ে জেবা খাতুনের সঙ্গে ছয় মাস আগে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে নিশানের।বিষয়টি দুই পরিবারের মধ্যে জানাজানি হলে গত নভেম্বর মাসে পারিবারিকভাবে তাদের আকদ হয়। এরপর ডিসেম্বর মাসের বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) তাদের বিয়ের দিন ধার্য করা হয়। বিয়ের এক সপ্তাহ আগে থেকেই ছেলের বাড়ি আলোকসজ্জার পাশাপাশি বিভিন্ন আয়োজন চলতে থাকে। কনের বাড়িতেও নানা আয়োজন চলে। তবে ছেলের বাড়িতে সবকিছুই যেন রাজ্যের আদলে তৈরি করা হয়। আতশবাজি, সাউন্ড বক্সে গান বাজানো, গায়ে হলুদ থেকে শুরু হয়ে সবকিছুই যেন রাজকীয় পরিবেশে করে তোলা হয়। বিয়ের দিন বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই বিয়ে বাড়িতে হাতি, ঘোড়ার গাড়ি ও পালকি দেখতে ভিড় করে এলাকাবাসী ও আমন্ত্রণ পাওয়া আত্মীয়-স্বজনেরা। এরপর বেলা গড়িয়ে দুপুর হলেই শত শত বরযাত্রী নিয়ে কনের বাড়িতে রওনা হয়। বর চোড়েন (ছাত্রলীগ নেতা) হাতির পিঠে, হাতে ছোট ছুরি আর তার পেছনে ঘোড়ার গাড়ির টমটম, পেছনে নববধূর জন্য পালকি নিয়ে শত শত বরযাত্রী পায়ে হেঁটে তিন কিলোমিটার এলাকা ঘুরে যান কনের বাড়িতে। তবে ছাত্রলীগ নেতা নিশানের ও কনের বাড়ির দুরত্ব ছিল মাত্র আধা কিলোমিটার। গ্রামবাসীকে দেখাতে ও ভাইরাল হতে মূলত পুরো গ্রামসহ পাশের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে ঘুরে কনের বাড়িতে যাওয়া হয়। বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) বিয়ে সম্পন্ন হলে রাতে ওই ছাত্রলীগ নেতার বাড়িতে আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। টানা দুইদিন চলা ওই অনুষ্ঠানে বাহিরে থেকে ভাড়া করে নেওয়া আসা কণ্ঠশিল্পীরা গান পরিবেশন করেন। শুক্রবার (২৭ ডিসেম্বর) ছাত্রলীগ নেতার বাড়িতে বৌভাতের আয়োজনে আমন্ত্রণ দেওয়া হয় প্রায় ৬ শতাধিক মানুষকে। এদিকে এর আগেই ওই বিয়ের দিনের ভিডিও সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।

শাওনের দাদা আওয়ামী লীগ নেতা মান্নান বিশ্বাস বলেন, চারদিনের অনুষ্ঠানে তিন দিন ছিল সংগীত সন্ধ্যা। যাত্রার জন্য কলকাতার নামকরা যাত্রাদলের কয়েক শিল্পীকে বিমানে উড়িয়ে আনা হয়েছিল। বৌভাতের অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন ১০ হাজার। রাতে ছিল আতশবাজির ঝলকানি।

মান্নানের দাবি, খুলনা বিভাগের প্রশাসনের সর্বস্তরের কর্মকর্তা তার নাতির বিয়েতে এসেছিলেন। বিয়ের আয়োজনে সোমবার পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৮৪ লাখ টাকার বেশি।

এদিকে ছাত্রলীগ নেতা নিশানের এরকম বিয়ের আয়োজনে ক্ষুব্ধ হয়েছেন অনেকেই। তারা বলছেন, দেশে যখন ছাত্রলীগ সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা গাঢাঁকা দিয়েছে, গ্রেফতার হচ্ছে। সেই সময়ে একজন ছাত্রলীগ নেতার এমন রাজকীয় বিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়।

ওই এলাকার আজিজুর রহমান নামের এক যুবক বলেন, ‘ছাত্রলীগ নেতা নিশান রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল। বিভিন্ন মিছিল-মিটিংয়ে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছে। অথচ ৫ আগস্টের পর থেকেই সে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে রাজকুমারের মতো বিয়ে করলেন। তাদের ক্ষমতার উৎস কোথায়?’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঝিনাইদহ জেলা সমন্বয়ক ও ছাত্র অধিকার পরিষদের শৈলকুপা উপজেলা শাখার সভাপতি রায়হান হোসেন রিহান বলেন, ‘ছাত্রলীগ নেতা নিশান দলীয় পদে থাকা সত্ত্বেও রাজকীয় বেশে ঢাকঢোল পিটিয়ে বিয়ে করছে তা আমরা ভিডিওতে দেখেছি। মূলত রাজনৈতিক দলের কিছু সুবিধাভোগী স্থানীয় নেতাদের ছত্রছায়ায় আওয়ামী লীগের দোসরেরা এলাকায় এখনো রাজত্ব কায়েম করছে। তাদের সহযোগিতা নিয়ে ছাত্রলীগ পরিবার এমন আয়োজন করতে পেরেছে। তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়া হয়। অথচ শৈলকুপায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন পর্যন্ত কাউকেই গ্রেপ্তার করেনি। তারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা আন্দোলন করে হাজারো প্রাণের বিনিময়ে স্বৈরাচার হাসিনার পতন ঘটিয়েছি অথচ তার দোসর ছাত্রলীগ নেতা রাজকীয় বেশে বিয়ে করছে। এতে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আমরা শঙ্কায় আছি।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক নেতা রাব্বী হোসেন বলেন, নিষিদ্ধ সংগঠনের নেতার এমন বিয়ের আয়োজন দৃষ্টিকটু। প্রশাসনের উচিত তাদের টাকার উৎস খতিয়ে দেখা।

জেলা ছাত্রদলের সভাপতি সৌমেনুজ্জামান সৌমেন বলেন, ‘একজন নিষিদ্ধ সংগঠনের নেতা এ ধরনের বিয়ের আয়োজন করেছে সেদিকে পুলিশের নজর দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। সেখানে তো নাশকতামূলক অনেক পরিকল্পনা হতে পারে।’

জেলা সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত হোসেন বলেন, ‘সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য বিজ্ঞ আদালত ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছেন। সেই নিষিদ্ধ সংগঠনের একজন নেতার বিয়ে এমন এলাহী কাণ্ডে হচ্ছে সেদিকে স্থানীয় প্রশাসনের নজর দেওয়া উচিত ছিল।’

এ বিষয়ে শৈলকুপা উপজেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নিশান আহমেদ শাওন বলেন, ‘সাবেক সংসদ সদস্য ভালোবেসে আমাকে ছাত্রলীগের পদ দিয়েছিল। আমার বয়স মাত্র ১৮। আমি এখনো কলেজে পড়ি।’ ছাত্রলীগের সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে সেসময়ে বিয়ে করা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো মিছিল মিটিংয়ে যাইনি। কারো কোনো ক্ষতি করিনি তাই এলাকার মানুষ আমাকে ভালোবাসে। তারা আমার ক্ষতি চায়না। এজন্যই আমি তাদের সহযোগিতা পেয়ে বিয়েতে বড় আয়োজন করতে পেরেছি।’

এ ব্যাপারে শৈলকুপা থানার ওসি মাসুম খান বলেন, পুলিশ এ বিয়ের বিষয়ে জানে না। বিয়ের অনুষ্ঠানে খুলনা বিভাগের প্রশাসনের কর্মকর্তা আসলে তার প্রটোকলে থাকার কথা।

আনন্দবাজার আরবি

সংবাদটি শেয়ার করুন