ঢাকা | শুক্রবার
২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উত্তরের সম্ভাবনাময় ফসল অড়হর

উত্তরের সম্ভাবনাময় ফসল অড়হর

একের ভেতর তিন

  • কম খরচে জমির আইলে এর চাষ করা যায়
  • শোভাবর্ধন-পরিবেশবান্ধব বেড়ার পাশাপাশি ফলনও মেলে
  • ডালজাতীয় ফসল অড়হর গাছের জ্বালানিও হয়
  • অড়হর চাষ সম্প্রসারণে বিএমডিএ’র উদ্যোগ

অড়হর একটি ভালো ডালজাতীয় অর্থকরি ফসল। সঠিক নিয়ম মেনে চাষ করতে পারলে যে কোনো ফসলের থেকে বেশি লাভ পাওয়া যায়। কারণ বাজারে সারাবছরই মুগডালের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অড়হর ডালের দামও যেমন ভালো থাকে, তেমনই চাহিদাও রয়েছে। ঔষুধি গাছ হিসেবেও এর জুড়ি নেই। যদিও অড়হর চাষে ভাল জমি নয়, অনুর্বর জমিই যথেষ্ট। কিংবা শুধুমাত্র জমির আইলে সারি করে লাগিয়ে অড়হর উৎপাদন করা যায়। মডেল হিসেবে দেখিয়ে উত্তরাঞ্চলে অড়হর এর চাষ সম্প্রসারণে উদ্যোগ নিয়েছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। তারা তাদের খননকৃত খালগুলোর চার ধারে বেড়া হিসেবে অড়হর লাগিয়েছে। এতে প্রকৃতিতে শোভাবর্ধনের পাশাপাশি ব্যাপক উৎপাদনও হচ্ছে, উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন কৃষকরা। আর এর বীজ সরবরাহের দায়িত্ব নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

জানা যায়, অড়হর এক প্রকার ডালবীজ-হার্ব জাতীয় বর্ষজীবি গাছ। পাতা কিছুটা লম্বা ও মাথা চোখা আকারের হয়। ফুল হলদে, এর বীজ ছোটো গোলাকার। ফল আকারে ছোটো কড়াইন শুটির মতো, কিন্তু একটু চ্যাপ্টা হয়। এটি যেকোন জমিতে জন্মায়। সারা বিশ্বে আনুমানিক ৪৪.৯ লক্ষ টন অড়হর ডাল উৎপাদন হয়। এই উৎপাদনের প্রায় ৬৩ শতাংশই ভারতে উৎপন্ন হয়। বাংলাদেশের রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া ও যশোর জেলায় অড়হরের চাষ করা হলেও তা খুব বেশি নয়। অড়হরের বীজ পাকে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে। আর জমিতে বীজ লাগাতে হয় এপ্রিল-মে মাসে অর্থাৎ বর্ষার আগে।

অড়হর লিগিউম পরিবারভূক্ত ডালজাতীয় ফসল, এর গাছ ঝোঁপালো, ঘন সবুজ পাতা ও ডালপালা যুক্ত। শুটিতে বীজ ধরে। অড়হরের বহুমুখী ব্যবহার এবং উপকারিতা আছে। অড়হরের রয়েছে অনেক ঔষধি গুণ। কাঁশি, জন্ডিস রোগ, অরুচি, জিহ্বার ক্ষত, অশ্বরোগ, রক্তপিত্তে অড়হর পাতা ও তার রস ব্যবহৃত হয়। জন্ডিসের প্রথমাবস্থায় অড়হর পাতার রস সামাস্য গরম করে খেলে উপকার পাওয়া যায়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতেও অড়হর পাতার রস কার্যকর। হাত-পায়ের জ্বালাপোড়া রোধ ও রুচি বাড়াতে কিংবা পুরনো কাঁশি দূর করতে অড়হর পাতার রস নিয়মিত খেলে উপকার পাওয়া যায়। ‘বেড়ায় ক্ষেত খায়’-এই প্রবাদের অর্থ হল রক্ষক যখন ভক্ষকের ভ’মিকায় অবতীর্ণ হয়। কিন্তু এর উল্টো চিত্র দেখা গেছে অড়হর চাষের ক্ষেত্রে। উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা সাধারণত অন্য ফসলের নিরাপত্তা বেষ্টুনি অর্থাৎ বেড়া হিসেবে জমির আইলে কিংবা খাল-পুকুরের পাড়ে অড়হর চাষ করেন। এতে অন্য ফসল যেমন গরু-ছাগলের হাত থেকে রক্ষা পায়, তেমনি অড়হরের ব্যাপক ফলনও হয়। 

কৃষকরা জানান, অড়হর লাগানোর ১২০ দিনের মধ্যে তা উত্তোলন করা যায়। স্বল্পমেয়াদি জাতের ক্ষেত্রে সারি ও গাছের দূরত্ব থাকবে এক ফুট, মধ্যমেয়াদি জাতে দুই ফুট এবং দীর্ঘমেয়াদি জাতে তিন ফুট/দুই ফুট দূরত্বে বীজ বোনা যায়। এর চাষে খরচ একবারেই নেই বললেই চলে, উর্বর জমিরও প্রয়োজন হয়না। শুধুমাত্র বীজের খরচটুকু দিলে জমির আইলে বাড়তি ফসল হিসেবে অড়হর চাষ করা যায়। বিঘাপ্রতি তিন থেকে সাড়ে তিন কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। তবে উচ্চ ফলনশীল নতুন নতুন বিভিন্ন ফসলের চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় ওষুধিগুণ সম্পন্ন ও সম্ভাবনাময় ডালজাতীয় ফসল অড়হর আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। এ ব্যাপারে কৃষকদের সচেতন করে তুলতে হবে বলেও জানান তারা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয সূত্রে জানা যায়, রংপুর অঞ্চলে চলতি বছর অড়হর চাষের লক্ষ্যমাত্রা ৭০ হেক্টর ধরা হলেও অর্জিত হয়েছে মাত্র ৩৬ হেক্টর। এর মধ্যে রয়েছে রংপুর জেলায় ৩০ হেক্টর, গাইবান্ধায় ৫ হেক্টর ও লালমনিরহাটে ১ হেক্টর। নানা কারণে অড়হর চাষ লাভজনক উল্লেখ করে সূত্র জানায়, কোনো অনুর্বর জমিতে অড়হরের চাষ অন্য কারণেও উপযোগী। কম খরচে এর চাষ করলে মাটিতে গাছের পাতা পড়বে, গাছও বেঁচে থাকার তাগিদে নিজের মতো করে রসদ জোগাড়ের চেষ্টা করবে। এভাবে ধীরে ধীরে অনুর্বর জমিও অন্য ফসল চাষের উপযোগী হয়ে উঠবে। ডাল জাতীয় ফসল হওয়ায় এটি মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। অড়হরের মূলে বায়ুমন্ডলের নাইট্রোজেন সঞ্চিত হয়, যার ফলে এই জাতীয় শস্য চাষে একদিকে যেমন জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় তেমনই এটি ভূমিক্ষয় রোধ করতেও সক্ষম। এছাড়া গাছ কিছুটা বড় হলে তার থেকে জ্বালানিও মেলে। অড়হর গাছ ফসলের উপকারী  পোকার আশ্রয় হিসেবে কাজ করে। ফলে চাষিদের লাভের পরিমাণ কিছুটা হলেও বাড়বে।

রংপুরের বদরগঞ্জে অবৈধভাবে দখল হওয়া ভাড়ারদহ বিল উদ্ধারসহ খনন করেছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। ভূ-উপরিস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে বৃহত্তর রংপুর জেলায় সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্পের (ইআইআরপি) আওতায় গত বছর খনন করা হলে হারানো প্রাণ ফিরে প্রায় ১২ একর আয়তনের এ বিলটি। সরেজমিনে ভাড়ারদহ বিলে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ১০০ ফুট চওড়া বিলের পাড়ে চারদিকে ডালজাতীয় ফসল অড়হর লাগানো হয়েছে। গাছে ঝুমঝুম করছে অড়হরের শুটি। বীজের জন্য শুটিগুলো সংগ্রহ করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ইআইআরপি প্রকল্পের পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান খান বলেন, শুধু ভাড়ারদহ’ই নয়, রংপুর অঞ্চলে খননকৃত খালগুলোর পাড়ে অড়হর লাগানো হয়েছে। এতে একদিকে যেমন অড়হরের গাছের বেড়ায় খালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে, তেমনি শোভাবর্ধনও হচ্ছে। অন্যদিকে আবার ফলনও দিচ্ছে অড়হর। এসব দেখে অড়হর চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন স্থানীয় কৃষকসহ বিলের পাড়ে আগত লোকজন। উত্তরাঞ্চলে সম্ভাবনাময় ডালজাতীয় ফসল অড়হর চাষ সম্প্রসারণে এখান থেকে বীজ সরবরাহ করা হবে উল্লেখ করে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জানান, এক বিঘা জমির চারদিকের আইলে এক কাঠার একটু বেশি জমি পাওয়া যায়। তাতে অন্তত ১৫ কেজি অড়হর ডাল উৎপাদন সম্ভব। এতে সামান্য খরচে যেমন বাড়তি লাভ মিলতে পারে চাষির, অন্যদিকে পরিবারের জন্য সারা বছরের পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থাও হয়ে যায়। অড়হর চাষ করে ডাল ফসলের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব এবং অড়হর ডাল উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্য।

সংবাদটি শেয়ার করুন