লালমনিরহাটের ৫ উপজেলার মানুষের ভাগ্য বদলে দিয়েছে ভুট্টা। ভুট্টার চাষ ও ব্যবসা করে প্রতিবছর লাখ লাখ টাকা আয় করছেন এ জেলার মানুষ। ভুট্টা নিয়ে নেই তাদের কোনো ঝামেলা বা কষ্ট। ফসল উঠা মাত্রই খুব সহজে কৃষকরা তা বিক্রয়ও করছেন। জেলার অধিকাংশ মানুষের জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন কৃষি। তার মধ্যে অন্যতম রবিশস্য ভুট্টা, যা সম্প্রতি এ অঞ্চলের ব্র্যান্ডিং পণ্য বলে পরিচিতি পেয়েছে। ভুট্টাচাষ বদলে দিয়েছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকা।
এক সময় চরে মানুষ না খেয়ে কষ্টে দিন পার করত। তবে গত ২৫ বছরে চর এলাকায় দৃশ্যপট বদলে গেছে। বালু মাটিতে ভুট্টাচাষ করে বদলে গেছে তাদের ভাগ্য। গ্রামগুলোতে খড়ের ঘরের পরিবর্তে উঠেছে আধাপাকা ঘর। এখন আর না খেয়ে থাকতে হয় না তাদের। ভুট্টা আসার পর থেকে সৃষ্টি হয়েছে কর্মসংস্থান। লালমনিরহাটে এখন ভুট্টাই প্রধান অর্থকরী ফসল। ভুট্টার দানা মানুষের খাদ্য হিসেবে এবং ভুট্টা গাছ ও সবুজ পাতা উন্নতমানের গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়। হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য হিসেবেও এর যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে।
লালমনিরহাটের পাঁচটি উপজেলাজুড়ে সবুজ পাতায় স্বপ্ন বুনছেন ভুট্টা চাষিরা। ইতোমধ্যে কোথাও কোথাও গাছে ফুল আসা শুরু হয়েছে। কোথাও তরতাজা হয়ে গাছ বেরিয়ে আসছে। কম সময়ে ও ভূগর্ভস্তরের পানি কম ব্যবহার করতে রবিশস্য আবাদের জন্য কৃষকরা ভুট্টা চাষে ঝুঁকছেন। তিস্তা ও ধরলাসহ ১৫ নদীর বুকে জেগে উঠেছে একাধিক চর। সেই চরে গড়ে উঠেছে বসতি। চলছে নানা জাতের ফসলের চাষাবাদ। তিস্তার বুকে সবচেয়ে বেশি চর জেগেছে জেলার হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী, উপজেলায়। অন্যদিকে ধরলার বুকে সবচেয়ে বেশি চর জেগে উঠেছে লালমনিরহাট সদর উপজেলায়। এসব চরের বুকে মানুষের বসতির পাশাপাশি বিভিন্ন জাতের ফসল চাষ শুরু হয়েছে।
ধরলা নদীতে লালমনিরহাট সদর উপজেলার মোগলহাট ও কুলাঘাটে পাঁচটি চর জেগে উঠেছে। এর মধ্যে দুটি চরে জনবসতি গড়ে উঠেছে। তাছাড়া ধরলা, রত্না ও সানিয়াজান নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় নদীর বুকে বোরো ধান চাষের পাশাপাশি ভুট্টা চাষের ধুম পড়েছে। ভুট্টা চাষের ধুম পড়েছে তিস্তার নদীর বুকেও। তিস্তার চরাঞ্চলে এ বছর আবহাওয়া অনুকূল ও ভুট্টায় পোকার আক্রমণ না থাকায় কৃষকরা বাম্পার ফলনের আশা করছেন। ভুট্টা চাষে প্রতি বিঘায় প্রায় ৬-৭ হাজার টাকা খরচ হয়। এছাড়া আলুর জমিতে ভুট্টার আবাদ করলে খরচ একটু কম হয়। ভুট্টার পর ওই জমিতে ধান ও পাট আবাদও হয়। প্রতি বিঘায় ভুট্টার ফলন আসে ৩৫-৪০ মণ। এছাড়া কমপক্ষে ২০-২৫ মণের মতো ফলন হয়। বাজারে নতুন ভুট্টার মণ -৭০০ শত থেকে ৮০০ শত টাকা। গতবছর কৃষকরা ভুট্টার ভাল দাম পাওয়ায় এবছর ভুট্টা চাষের দিকে বেশী ঝুকছে কৃষকরা।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, তিস্তা নদীতে পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম ইউনিয়ন, হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান, সিঙ্গিমারী, গোড্ডিমারী, সিন্দুর্ণা, পাটিকাপাড়া, ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়ন, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, তুষভাণ্ডার, কাকিনা ইউনিয়ন, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়ন, লালমনিরহাট সদর উপজেলার গোকুণ্ডা, খুনিয়াগাছ ও রাজপুর ইউনিয়নে ছোট-বড় প্রায় ৬৩টি জেগে ওঠা চরে প্রচুর পরিমানে ভুট্টার চাষ হচ্ছে। ভুট্টার চাষিরা জানান, প্রতি বছর ছয় মাস পর পর ভুট্টা চাষ শুরু হয়। ভুট্টা চাষের শুরুতেই দাম বেড়ে যায় ডিজেল, সার ও বীজের। এতে সাধারণ কৃষকরা স্থানীয় দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অংকের সুদ নিয়ে চাষ শুরু করেন। ফলন ভালো হলে ভালো, না হলে পথে বসতে হয় কৃষকদের।
এদিকে কৃষি ব্যাংকগুলো ভুট্টা চাষের ওপর ঋণ দিলেও সেই ঋণ তুলতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় কৃষকদের। ভুট্টা প্রক্রিয়াজাত কারখানা চালু হলে স্থানীয় বাজারে ভুট্টার দাম নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি সেখানে এলাকার বেকার যুবকদের কাজ করার সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করে সচেতন মহল। কৃষি বিভাগের পাশাপশি ভুট্টা চাষিদের স্বাবলম্বী ও বাজার নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছে বেসরকারি বিভিন্ন এনজিও।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, লালমনিরহাটে ২০২০ থেকে ২১ অর্থ বছরে রবি মৌসুমে ৩৫ হাজার ২৪০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ হয়েছে। চলতি অর্থবছর ভুট্টা চাষের জমির পরিমাণ আরও প্রায় দুই হাজার হেক্টর বেড়েছে। প্রতি বছর তামাক চাষ ছেড়ে দিয়ে ভুট্টা চাষের দিকে ঝুঁকছেন কৃষকরা। এ বছর ভুট্টা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩২ হাজার ১০০ মেট্রিক টন। গত মৌসুমে এ অঞ্চল থেকে প্রায় দুই লাখ ৮২ হাজার টন ভুট্টা উৎপাদন হয়। লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শামীম আশরাফ জানান, লালমনিরহাট জেলাজুড়ে ব্যাপক ভুট্টাচাষ হয়েছে। বিশেষ করে নদীর চরগুলোতে ভুট্টার বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে। জেলার পাচঁ উপজেলায় আমাদের কৃষি অফিসাররা মাঠ পর্যায়ে গিয়ে ভুট্টাচাষের জন্য কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে আসছেন।
আনন্দবাজার/এম.আর