উপকূলে শহরের ছোঁয়া –৪
‘আমাদের রহিমে বিদেশ থেকে ভিসা পাঠিয়েছে। ডিজিটাল তথ্য কেন্দ্র থেকে নিয়ে এসেছি। রাতে ছেলে ফোন করে বলেছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে কম্পিউটারে ভিসা পাঠিয়ে দেবে। সঙ্গে কিছু টাকাও পাঠিয়েছে।’
আঞ্চলিক ভাষায় এমনটাই বললেন নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত সোনাদিয়া ইউনিয়নের চরচেঙ্গা গ্রামের রওশন আরা বেগম। তার ছেলে আব্দুল রহিম মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে থাকেন। এখন ছোট ছেলে করিমকে বিদেশে নেওয়ার জন্য ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে ভিসা পাঠিয়েছেন। অল্প সময়ে ভিসা হাতে পেয়ে বেশ খুশি রওশন আরা।
এ গ্রামের অনেকেই এখন ইউনিয়ন ডিজিটাল তথ্য সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে ইন্টারনেট-নির্ভর সুবিধা পাচ্ছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেও উদ্যোক্তা হচ্ছেন তরুণরা। কম্পিউটার শিখে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চাকরিও করছেন অনেকেই। উন্নয়নের পথপরিক্রমায় এখন প্রান্তিক মানুষের নাগরিক সেবার আস্থার প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে এটি। দক্ষ জনশক্তি গড়ার এই কর্মযজ্ঞকে আরও গতিশীল ও আধুনিকায়ন করার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
সোনাদিয়া ইউনিয়ন ডিজিটাল তথ্যসেবা কেন্দ্রের পরিচালক মুজাম্মেল হোসেন মিলন বলেন, ডিজিটাল তথ্য সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রতিদিন শতাধিক মানুষ সেবা নিচ্ছেন। এমন কোনও সেবা নেই যেটা এখান থেকে দেওয়া হয় না। এক কথায় বললে, ইন্টারনেটনির্ভর যত সেবা রয়েছে সবগুলো নামমাত্র মূলে পাওয়া যাচ্ছে। কারণ, এর যাবতীয় যন্ত্রপাতি সরকারের পক্ষ থেকেই সরবরাহ করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এখানে বিদ্যুৎ নেই। সৌরশক্তির মাধ্যমে আমরা সারাক্ষণ সব সেবা দিতে পারছি। উদ্যোক্তাও তৈরি করছি। অনেকেই প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন খামার তৈরি করেছেন। ব্যবসা করছেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন। কয়েক বছর আগে আমাকেই কম্পিউটার শিখতে জেলা সদরে যেতে হয়েছিল।
নিঝুমদ্বীপের নামারবাজারের কম্পিউটার দোকানি রুবেল উদ্দিন বলেন, ‘পড়াশোনা শেষ করে চাকরির জন্য অনেক চেষ্টা করি। উপায় না পেয়ে ইউনিয়ন ডিজিটাল তথ্য সেবা কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিই। এখন নিজেই একটি কম্পিউটার কিনে দোকান দিয়েছি। আমার পরিবারও সুন্দরভাবে চলছে।’
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ডিজিটাল বাংলাদেশের অন্যতম লক্ষ্য সব সেবা ডিজিটাল প্লাটফর্মে এনে সেবাপ্রাপ্তির বিষয়টি সহজ ও দুর্নীতিমুক্ত করা। বর্তমানে সারা দেশের ৪ হাজার ৫০০টি ইউনিয়ন, ৩২৯টি পৌরসভা, সিটি করপোরেশনগুলোর ওয়ার্ড নিয়ে এখন পর্যন্ত ৫ হাজার ৮৬৫টি ডিজিটাল সেন্টার রয়েছে। এই সেন্টারগুলো থেকে প্রতি মাসে সেবা নিচ্ছেন প্রায় ৬০ লাখের বেশি মানুষ। যার অধিকাংশই গ্রামের। কর্মসংস্থান হয়েছে ১১ হাজার তরুণের। প্রায় সাড়ে ছয় লাখ আইটি ফ্রিল্যান্সার তৈরি হয়েছে। গ্রামে বসেই তারা উদ্যোক্তা হয়েছেন। যদিও এই সেবাকেন্দ্র শুধু ইউনিয়নেই সীমাবদ্ধ নেই। গার্মেন্ট কর্মীদের জন্যও স্পেশালাইজড ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে।
দুই শতাধিক সেবা
ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে গিয়ে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, পাসপোর্টের আবেদন, ভিসা প্রসেসিং ও ভিসা চেকিং, জাতীয় পরিচয়পত্রের আবেদন ও সংশোধন, সরকারি ফরম পূরণ, বিদ্যুৎ বিল প্রদান, নাগরিক সনদপত্র, চারিত্রিক সনদপত্র, পর্চার আবেদন, হজ নিবন্ধন, চাকরির আবেদন, পরীক্ষার ফলাফল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির আবেদন, মোবাইল ফোন রিচার্জ, সিম ক্রয়, ইমেইল ইন্টারনেট ও ভিডিও কল, মোবাইল ব্যাংকিং, বাস, ট্রেন ও বিমানের টিকিট ক্রয়সহ দুই শতাধিক সেবা অনলাইনে আছে। এসব সেবা দুর্গম গ্রামে বসেই ইউনিয়ন ডিজিটাল তথ্যসেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে।
২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শীর্ষক নির্বাচনি ইশতেহারের মধ্য দিয়ে এ স্বপ্নের যাত্রা। ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী তার কার্যালয় থেকে এবং নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) প্রশাসক মিস হেলেন ক্লার্ক ভোলা জেলার চর কুকরিমুকরি ইউনিয়ন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সারাদেশের সকল ইউনিয়ন পরিষদে একটি করে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) একযোগে উদ্বোধন করেন।
যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, শহরের সব সুবিধা গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সুযোগ্য সন্তান ও আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় কাজ করে যাচ্ছেন। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেবা কেন্দ্রগুলো ঠিক সেই লক্ষ্যই বাস্তবায়ন করছে। এসব সেবা কেন্দ্রে দুই শতাধিক ধরনের সেবা পাচ্ছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।
আনন্দবাজার/শহক