শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তৃতীয় লিঙ্গের পলি এখন সফল উদ্যোক্তা

প্রতিমাসে আয় দেড় লাখ টাকা

হিজড়া। একটি অবহেলিত গোষ্ঠির নাম। পরিবার থেকেই যারা অবজ্ঞার শিকার। ছোট থেকেই মাথা তুলে দাঁড়ানোর শক্তিটা তাদের থেকে কেড়ে নেয়া হয়। কোথাও জায়গা হয় না। সমাজে তারা অবহেলিতদের কাতারে। ঘুরে ঘুরে কোন এক গুরু মা’র আশ্রয়ে জীবন পার করতে হয়। পলিও একজন হিজড়া। তবে, হিজড়াদের জন্য ‘পলি’ একটি আলোর নাম।

পলির কাজের স্বীকৃতির জন্য রাজশাহী জেলা প্রশাসন তাকে ২০১৭ সালে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত করে। এছাড়া এসএমই আঞ্চলিক পণ্য মেলা-২০২০ এ দ্বিতীয় নারী উদ্যোক্তার পুরস্কার পান তিনি। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন তাকে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর করোনাকালীন মানবিক যোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

পলি জানান, ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকির শখ ছিলো তার। স্কুলে ড্রয়িংয়ে খুব ভালো ছিলেন। কিন্তু ড্রয়িংয়ের উপর উচ্চতর পাঠ নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে আঁকাআঁকি থেমে নেই। সেই কাজই এখন তাকে সাফলতা এনে দিয়েছে। তিনি এখন আঁকেন থ্রি-পিস কাপড় ও শাড়িতে। নিজের ফ্যাশন হাউজের থ্রি-পিস ও শাড়িতে তিনিই নিজেই ডিজাইন করেন। শুধু ডিজাইন না, সেই ডিজাইনের ওপর আপ্লিকস ও বুটিকসের কাজও করেন তিনি।

তবে অবশ্য ব্যবসা বড় হয়ে যাওয়ায় এখন তাকে ঠিক সেভাবে অ্যাপ্লিক ও বুটিকসের কাজ না করলেও চলে। তার অধীনেই এখন চারশতাধিক হিজড়া জনগোষ্ঠি ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠির নারীরা কাজ করেন। হিজড়া জনগোষ্ঠির হয়েও তিনি এখন সফল একজন নারী উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী।

রাজশাহী মহানগরীর মোল্লাপাড়া এলাকায় নিজ বাড়িতেই তিনি গড়ে তুলেছেন তার ‘ডি এ ফ্যাশন হাউজ’। তার এই ফ্যাশন হাউজ সার্বক্ষণিক ২০ জন লোক কাজ করেন। যার মধ্যে ১০ জনই হিজড়া জনগোষ্ঠির। নিজ বাড়িতেই বাবা-মাকে রেখে তাদের দেখভালও করেন তিনি। সেই জয়িতা পলিই এখন নারীদের অ্যাপ্লিকস ও বুটিকসের ওপর প্রশিক্ষণ দেন।

আরও পড়ুনঃ  ব্লকে সাড়ে ১৯ কোটি টাকার লেনদেন

জয়িতা পলির শুরুটা ২০১৪ সালে মাত্র ৮ হাজার টাকা নিয়ে। সেই তিনিই এখন ১৮ লাখ টাকার মালিক। সব খরচ বাদে তার ক্যাশের পরিমাণ এখন ১৮ লাখ টাকা। তার এই ফ্যাশন হাউজের ওপর এখন অনেক পরিবার নির্ভরশীল। তার ফ্যাশন হাউজ থেকে বিভিন্ন ধরনের হাতের তৈরি শাড়ী, থ্রি-পিস, বেড সীট ও কুশন কভার তৈরি করে বিক্রি করা হয়। তার ফ্যাশন হাউজ থেকে তৈরিকৃত এসব পণ্য ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্নস্থানে বিক্রি হয়।

জয়িতা পলি জানান, ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই অল্প অল্প করে ডিজাইন করতাম। এসএসসিতে পড়াকালীন সময়েই হিজড়া কমিউনিটি রাইটস নিয়ে কাজ শুরু করি। যে প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ করতাম তা ২০১২ সালে শেষ হয়ে যায়। এএইচএসসি পাশের পর মাত্র ৮ হাজার টাকা নিয়ে স্বল্প পরিসরে বুটিকসের কাজ শুরু করি। বাজার থেকে কাপড় কিনে নিয়ে এসে নিজেই ডিজাইন করে অ্যাপ্লিক ও বুটিকসের কাজ করে তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি শুরু করি। স্থানীয় লোকজনের মধ্যেও তা দু একজন কিনতে শুরু করে। তবে হিজড়া জনগোষ্ঠির হওয়ায় প্রথমে লোকজন কিনতে চাইতো না। ডিজাইন এবং বুটিকস ও অ্যাপ্লিকসের কাজ ভালো হওয়ায় ধীরে ধীরে ক্রেতা বাড়তে থাকে।

শুরুতে শাড়ির ওপরই বেশি কাজ করা হতো। যশোরের এক ক্রেতার মাধ্যমে কলকাতাতেও বিক্রি হতো সেইসব শাড়ি। তিনি মারা যাওয়ার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। এখন বেশিরভাগ থ্রি-পিস তৈরি হয় তার ফ্যাশন হাউজ থেকে। প্রতি মাসে ৭০০ পিস থ্রি-পিস ও ৫০ পিস শাড়ি তৈরি হয় তার ফ্যাশন হাউজ থেকে। তার কাছ থেকে চট্টগ্রাম, সিলেট ও ঢাকায় পণ্য কিনে নিয়ে সেখানে বিক্রি হয় বলে জানান তিনি। এছাড়া সিলেটের বেশকিছু ব্যবসায়ী তার কাছ থেকে পণ্য কিনে নিয়ে সরাসরি লন্ডনে পাঠায়।

জয়িতা পলি জানান, তার হাউজ থেকে তৈরি এক একটি থ্রি-পিস বিক্রি হয় ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ জাচার টাকায়, ওয়ান পিস বিক্রি হয় ৭০০ থেকে এক হাজার ১০০ টাকায়, টু-পিস বিক্রি হয় দেড় হাজার থেকে দুই হাজার ২০০ টাকায় এবং শাড়ি বিক্রি হয় দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার ৫০০ টাকায়। খরচ বাদে গড়ে প্রতিমাসে তার দেড় লাখ টাকার মতো আয় হয়।

জয়িতা পলি জানান, হিজড়া জনগোষ্ঠির হলেও আমাকে কখনো আদি পেশায় নামতে হয়নি। বরং অনেক হিজড়া জনগোষ্ঠির মানুষকে আমি কর্মের ব্যবস্থা করে তাদের আদি পেশা থেকে সরিয়ে এনেছি। তারপও শুরুতে জেন্ডার আইডেনটিটির কারণে অনেক প্রবলেম ফেস করতে হয়েছে আমাকে। এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র হিজড়া জনগোষ্ঠির হওয়ার কারণে আমাকে ব্যাংক লোন দেয়া হয়নি। অথচ বড় পরিসরে বিজনেস পরিচালনার জন্য তার ব্যাংক লোন প্রয়োজন বলে জানান তিনি।

আরও পড়ুনঃ  বোনাস বিনিয়োগকারীদের বিওতে পাঠিয়েছে এনসিসি ব্যাংক

জয়িতা পলির কাজের স্বীকৃতির জন্য রাজশাহী জেলা প্রশাসন তাকে ২০১৭ সালে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত করে। এছাড়া এসএমই আঞ্চলিক পণ্য মেলা-২০২০ এ দ্বিতীয় নারী উদ্যোক্তার পুরস্কার পান তিনি। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন তাকে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর করোনাকালীন মানবিক যোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

হিজড়া জনগোষ্ঠির রুবিনা বলেন, আগে আমি আদি পেশার সাথে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু এখানে এসে কাজ শুরুর পর আমার নিজের খরচ আমি নিজেই চালাতে পারি। মাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা আয় হয় বলে জানান তিনি।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন