ঢাকা | রবিবার
১৯শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
৫ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জামদানি-নকশিকাঁথার বিশ্বায়ন, প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী

ভারতের আন্তর্জাতিক মেলায় বাংলাদেশ ছাড়াও অংশ নিয়েছে আফগানিস্তান, বাহরাইন, কিরগিজস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তিউনিসিয়া ও তুরস্ক। পাঁচটি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের পণ্য প্রদর্শিত হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ লোকশিল্প ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, প্রাণ এগ্রো লিমিটেড, আধুনিক জামদানি ও থ্রি পিস, আধুনিকা, জেডএম ট্রেডার্স। প্রদর্শিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে- নকশিকাঁথা, জামদানি, ঢাকাই মসলিন, মিরপুর কাতান, রাজশাহী সিল্ক, বুটিক, সব ধরনের শাড়ি, পাটের পণ্য, কাঠের কারুপণ্য।


চিরন্তন বাঙলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, অহংকার আর তাঁত শিল্পের শিল্পিত ক্যানভাসে জামদানি বহুকাল ধরেই বিশ্বব্যাপী খ্যাত ও সমাদৃত। জামদানির বুনন পৃথিবীর অন্য কোনো তাঁতিদের পক্ষে সম্ভব নয়। এমনকি ঢাকার কয়েকটি এলাকা ছাড়া দেশের আর কোথাও এমন বুননা সম্ভব হয়নি। আদিকাল থেকেই এখানে বংশানুক্রমিক বসবাস করে আসছেন গুণী তাঁতি। তাই জামদানি একান্তই ঢাকার, একান্তই বাংলাদেশের। আর নকশিকাথার সঙ্গে জড়িয়ে আছে চিরন্তন বাঙালির সুখ-দুঃখ, বিরহ-বেদনার ঐতিহ্য। পল্লী কবি জসীম উদ্ দীনের নকশিকাঁথার মাঠে সেই চিত্রই আমরা দেখতে পাই।

নকশী কাঁথাটি বিছাইয়া সাজু সারা রাত, আঁকে ছবি,
ও যেন তাহার গোপন ব্যথার বিরহিয়া এক কবি।
সারা গায় তার জড়ায়ে রয়েছে সেই যে নকসী-কাঁথা,
আজও গাঁর লোকে বাঁশি বাজাইয়া গায় এ করুণ গাথা।
সেই হতে গাঁর নামটি হয়েছে নকশী-কাঁথার মাঠ।
ছেলে বুড়ো গাঁর সকলেই জানে ইহার করুণ পাঠ।’

কবির সেই আনন্দ-বিরহের নকশিকাঁথা আজকের এই বিশ্বায়নের যুগে ডান মেলছে দিন দিন। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশে এর প্রদর্শনী হচ্ছে। রফতানিও হচ্ছে। বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক কোনো মেলায় বাঙলার এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পের প্রদর্শনী ও বিক্রির জন্য উপস্থাপন করছে। ভারতের রাজধানী দিল্লিতে গত ১৪ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া ভারত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় (আইআইটিএফ) নকশিকাঁথা ছাড়াও জামদানি, ঢাকাই মসলিন শাড়ি, পাট ও কাঠের কারুকাজ প্রদর্শিত হচ্ছে। আগামী ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে এ মেলা। করোনা মহামারির কারণে গতবছর বন্ধ থাকলেও এবার মেলার আয়োজনে উৎসাহ দেখা গেছে।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সূত্রমতে, ভারতের আন্তর্জাতিক মেলায় স্থানীয়দের সঙ্গে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, বাহরাইন, কিরগিজস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তিউনিসিয়া ও তুরস্ক অংশ নিয়েছে। মেলায় অংশ নিতে ইপিবির মাধ্যমে পাঁচটি বাংলাদেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত হয়েছে। সেগুলো হলো- বাংলাদেশ লোকশিল্প ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, প্রাণ এগ্রো লিমিটেড, আধুনিক জামদানি ও থ্রি পিস, আধুনিকা, জেডএম ট্রেডার্স। বাংলাদেশের স্টলের পণ্যগুলোর মধ্যে থাকছে- নকশিকাঁথা, জামদানি, ঢাকাই মসলিন, মিরপুর কাতান, রাজশাহী সিল্ক, বুটিক ও সব ধরনের শাড়ি, পাটের পণ্য, কাঠের কারুপণ্য এবং পানীয়, মিষ্টান্ন ও রান্নার আইটেম।

বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক ড. আহমেদ উল্লাহ আনন্দবাজারকে বলেন, আন্তর্জাতিক কোনো বাণিজ্যমেলায় এটাই প্রথম তাদের অংশগ্রহণ। সেখানে জামদানি শাড়ি, নকশিকাঁথা, পাটজাত পণ্য ও তৈজসপত্র প্রদর্শনী ও বিক্রয় হবে। বিক্রির লক্ষ্য মাত্রা কত এই প্রশ্নে তিনি বলেন, আসলে বিক্রিটা এখানে মুখ্য নয় বরং দেশের বাইরে প্রথম কোনো মেলায় অংশ নিয়ে দেশের পণ্য প্রদর্শনীই উদ্দেশ্য। বলেন, ইতোপূর্বে বিভিন্ন দেশের প্রদশনীতে অংশ নিলেও আন্তর্জাতিক কোনো মেলায় এটিই প্রথম অংশগ্রহণ।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের ঢাকা জেলাতেই মসলিন চরম উৎকর্ষ লাভ করে। ঢাকা জেলার সোনারগাঁও, ধামরাই, তিতাবাড়ি, বাজিতপুর, জঙ্গলবাড়ি প্রভৃতি এলাকা মসলিনের জন্য সুবিখ্যাত ছিল। ইউরোপীয়, ইরানী, আর্মেনিয়ান, মুঘল, পাঠান প্রভৃতি বণিকেরা মসলিন ও জামদানি ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত ছিলেন। এ কারণে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধানেরাও এই শিল্প বিকাশে ভূমিকা রেখেছেন। ঢাকাই মসলিনের স্বর্ণযুগ বলা হয় মুঘল আমলকে। এ সময় দেশে-বিদেশে মসলিন, জামদানির চাহিদা বাড়তে থাকে এবং শিল্পেরও ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়।

আঠারো শতকে ইংরেজ দলিল থেকে জানা যায় মলমল খাস ও সরকার-ই-আলি নামের মসলিন সংগ্রহ করার জন্য দারোগা-ই-মলমল পদবীর উচ্চ পর্যায়ের রাজ কর্মচারী নিযুক্ত ছিলেন। প্রতিটি তাঁতখানায় একটি দপ্তর ছিল এবং এখানে দক্ষ তাঁতি, নারদিয়া, রিপুকার প্রভৃতি কারীগরদের নিবন্ধন করে রাখা হত। দারোগার প্রধান কাজ ছিল মসলিন ও জামদানি তৈরির বিভিন্ন পদক্ষেপে লক্ষ্য রাখা। তৎকালীন সময়ে ঢাকা থেকে প্রায় একলক্ষ টাকা মূল্যমানের মলমল-খাস মোঘল দরবারে রপ্তানি করা হত।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে ঢাকার ডেমরায় জামদানি পল্লীর তাঁতিদের আর্থিক সাহায্য দেয়া হয়। তবে পারিশ্রমিক, বিভিন্ন কলকারখানা ও ব্যাটারিচালিত চালিত গাড়ি হওয়ার কারণে তাঁতীরা আর এ পেশায় আসতে চাইছেন না। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার অচল তাঁতগুলো প্রাচীন গৌরবগাঁথার নীরব সাক্ষী হয়ে রয়েছে। জামদানি শাড়ি অনেক প্রকারের হয়। তবে প্রাথমিকভাবে জামদানি শাড়ির উপাদান অনুযায়ী এটি দুই প্রকার।

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন