তারাগঞ্জের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের মন্টু বর্মণের সংসার চলতো চাষাবাদ করে। তিনি প্রধানত ধান, পাট আর সবজির আবাদ করলেও খরচ বাদ দিয়ে তেমন একটা লাভের মুখ দেখতেন না। তবে সেই দিন গত হয়েছে তার। এই কৃষকের আয় বাড়িয়ে দিয়েছে চা। নিভৃত পল্লিতে চা পাতার চাষ করে ভাগ্য বদলে গেছে তার। উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়ার পাশাপাশি ইকরচালী ইউনিয়নের বালাপাড়ায় কয়েক বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে পাশের বাহাগিলি গ্রামেও চাষের আবাদ হচ্ছে। এই গ্রামটি নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার বাহাগিলি ইউনিয়নে অবস্থিত।
গ্রামগুলোর বাসিন্দারা জানান, কয়েক বছর আগেও তাদের এলাকার বেশির ভাগ জমি খালি পড়ে থাকতো। সেই দৃশ্যে পরিবর্তন আসে সিনহা এগ্রো বেইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের চা বাগান দেখে। সিনহা এগ্রো ২০১৩ সালে বালাপাড়া গ্রামে প্রায় চার একর জমিতে চা চাষ শুরু করে। সেখানে সফল হওয়ার পর তারা পাশের বাহাগিলি এলাকায়ও ১২ একর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে চা পাতা উৎপাদনে যায়। শেষে প্রতিষ্ঠানটির দেখানো পথে গ্রামগুলোর অনেকে ব্যক্তিগতভাবে চা চাষে নেমে পড়েন।
মন্টু বর্মণ প্রথম ২০১৭ সালে তারাগঞ্জের যমুনেশ্বরী নদীর ধারে চা বাগান দেখেন। সেখান থেকে পরিকল্পনা করেন, তিনিও চা চাষ করবেন। পরে মেয়ের জামাইয়ের সহযোগিতায় ২০১৮ সালে চা গাছের চারা এনে ৬০ শতাংশে বাগান করেন। পরে এই বাগান ছড়িয়ে যায় দেড় একরে। বাগান থেকে পাতা সংগ্রহের সময় কথা হয় মন্টু বর্মণের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পঞ্চগড় থেকে দুটি পিকআপ ভ্যানে চা গাছের চারা এনে লাগিয়েছি। ওখানকার শ্রমিকেরা চারা রোপণ করে দিয়ে গেছে। চারা, শ্রমিক, সার সব মিলিয়ে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। এখন বছরে চারবার পাতা সংগ্রহ করি। এ পর্যন্ত খরচ বাদে তিন লাখ টাকা আয় করেছি। ১২০ শতক জমিতে চা বাগান আছে। আরও বাড়াব। চা চাষ সহজ ও ব্যয় কম। কোম্পানির গাড়ি বাগানে এসে চা পাতা কিনে নিয়ে যায়। এবার আড়াই হাজার কেজি পাতা পেয়েছি। প্রতি কেজি পাতা ২২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি।’
বালাপাড়া গ্রামে গিয়ে কথা হয় গৃহবধূ মন্নুজা খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত জাগায় চায়ের গাছ নাগাছি। সেই গাছের চা পাতা বেচে তেল সাবানের খরচ চালেও কিছু জমা করুছি।’ বাহাগিলি গ্রামে চায়ের গাছে সেচ দিচ্ছিলেন নজরুল ইসলাম। তিনি জানান, চা চাষে কোনো ঝামেলা নেই। নেই বেশি পরিশ্রম। চা চাষ অত্যন্ত সহজ ও লাভজনক। যেসব জমিতে অন্য কোনো ফসল হয় না, সেখানে সহজে চায়ের চাষ করে লাভবান হওয়া যায়। প্রতিটি চা গাছ থেকে ২৫ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত পাতা পাওয়া যায়। খরচ বাদে প্রতি একরে চা চাষ করে বছরে এক লাখ টাকার বেশি আয় করা যায়।
বালাপাড়ায় নিজেদের চা বাগানে শ্রমিক দিয়ে পরিচর্যার কাজ তদারকি করার সময় কথা হয় সিনহা এগ্রো বেইজের ব্যবস্থাপক দুলাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বালাপাড়া ও বাহাগিলি গ্রামের লোকদের সহযোগিতায় আমরা ১৬ একর জমিতে চা চাষ করছি। সেই সঙ্গে ওই গ্রাম দুটির যারা চা চাষ করতে আগ্রহী ছিল, তাদের গাছের চারা এনে দিতে সহায়তা করেছি।
দুলাল হোসেন জানান, চারা লাগাতে ১৮ ইঞ্চি গভীর ও চারদিকে ১২ ইঞ্চি প্রস্থ করে গর্ত খুঁড়তে হয়। প্রতি গর্তে দুই কেজি পচা গোবর, ১০ গ্রাম টিএসপি, তিন গ্রাম পটাশ ও দুই গ্রাম দানাদার কীটনাশক দেওয়ার ১৫ দিন পর চারা লাগাতে হয়। গাছে বছরে পাঁচটি সেচ দিতে হয়। সব মিলিয়ে এক একর জমিতে চারা লাগাতে খরচ হয় ৬০ হাজার টাকা। দুই বছর পর থেকে চা পাতা সংগ্রহ করা যায়।
বছরে এক একর জমিতে লাগানো গাছ থেকে আট হাজার কেজি চা পাতা পাওয়া যায়। এই চা পাতা কিনে নিয়ে যায় পঞ্চগড়ে অবস্থিত নর্থ বেঙ্গল সেন্ট্রাল টি ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। শুধু তারাগঞ্জেই নয়, রংপুরের বদরগঞ্জ , গংগাচড়া ও সদরের বেশ কিছু এলাকায় চাষ হচ্ছে চা। আর ধানের পরিবর্তে চা চাষ করে নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন এখানকার কৃষকরা।
কৃষি সম্প্রারণ অধিদপ্তর রংপুরের অতিরিক্ত পরিচালক বিধু ভুষণ রায় বলেন, চা একটি জনপ্রিয় পানীয়। এর চাহিদা সর্বজনে। রংপুরের মাটিতে চা চাষ ভালো হচ্ছে। অন্য এলাকায় গাছ লাগানোর তিন বছর পর চা পাতা সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু রংপুরে চারা লাগানোর দুই বছরের মাথায় পাতা পাওয়া যাচ্ছে।
আনন্দবাজার/শজক