- চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ
- এক লাখ কোটি টাকার রফতানি লক্ষ্যমাত্রা
- দেশের প্রথম বায়োটেক কোম্পানির বিনিয়োগ ২৫৫০ কোটি টাকা
তথ্যপ্রযুক্তির মহাবিপ্লবের হাত ধরে বিশ্বব্যাপী শুরু হওয়া চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। উচ্চমাত্রার প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদন ও বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে সারাদেশে সাতটি অপারেশনালসহ ৩৯টি হাইটেক পার্ক নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি পার্কের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। শিগগিরই আরো তিনটির কাজ শেষ হবে। এর মধ্যেই এসব পার্কে প্রায় ১৩ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, সবগুলো হাইটেক পার্কের নির্মাণ কাজ শেষ হলে বিপুল সংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
সরকারের আশা, আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ এসব হাইটেক ও সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক থেকে বছরে এক লাখ কোটি টাকার সফটওয়্যার রফতানি করা যাবে। তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের হাইটেক পার্কগুলোতে অর্ধলক্ষাধিক কর্মসংস্থান হবে। আইটি (তথ্য প্রযুক্তি) খাতের এসব পার্ক থেকে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে শতকরা ১০ ভাগ হারে প্রণোদনা দেয়া হবে।
সূত্রমতে, আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে ৫৫ হাজার তরুণ-তরুণীকে আইটি খাতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে কাজ করছে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ (বাহাটেপাক)। তারা বলছে, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে আইটিতে দক্ষতা সম্পন্ন এক লাখ ও ২০৪১ সালের মধ্যে দেড় লাখ দক্ষ জনবল তৈরি হবে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মধ্যমে ইতোমধ্যে আইসিটি খাতে তৈরি হয়েছে সাড়ে ২৮ হাজার দক্ষ জনবল।
দেশের প্রথম ও সর্ববৃহৎ হাইটেক পার্ক গড়ে উঠেছে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে। ‘বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি’ নামের এই প্রযুক্তি পল্লিতে বিনিয়োগ করতে ভিড় করেছেন দেশের বড় বড় বিনিয়োগকারীরা। তবে বিপুল চাহিদা থাকার কারণে এ পল্লির প্লট প্রায় শেষের দিকে। সে কারণে উদ্যোক্তাদের জায়গা দিতে সরকার বিভাগীয় শহরসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে হাইটেক পার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা করে। এরই অংশ হিসেবে সারাদেশের ৩৯টি জেলায় হাইটেক পার্ক গড়ে তুলছে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। যার মধ্যে ১২টি পার্ক গড়ে উঠবে ভারতের ঋণ সহায়তায়।
হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, বর্তমানে বিনিয়োগের উপযুক্ত অবস্থায় রয়েছে সাতটি পার্ক। এগুলো হচ্ছে, কাওরান বাজারে ভিশন-২০২১ সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, নাটোরে শেখ কামাল আইটি ট্রেনি এন্ড ইনকিউবেশন সেন্টার, রাজশাহীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্ক, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি, চুয়েটে শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং এন্ড ইনকিউবেশন সেন্টার, সিলেটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্ক এবং চট্টগ্রামে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক।
বিনিয়োগ উপযোগী এসব পার্কের মধ্যে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতেই করোনা মহামারির মধ্যেও ৬৬১ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। পাশাপাশি ওরিক্স বায়োটেক নামের একটি প্রতিষ্ঠান দুই হাজার ৫৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু হাইটেকে এখন পর্যন্ত ৪৮টি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১১১৭.৫৮ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গেছে।
সূত্রমতে, দেশের প্রথম বায়োটেক কোম্পানি হিসেবে ওরিক্স বায়োটেককে বঙ্গবন্ধু সিটিতে এক দশমিক ৬৫ লাখ বর্গফুট সম্পূর্ণ প্রস্তুত করা জায়গাসহ ২৫ একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠান আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে দুই হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। আগামী বছরের মার্চ থেকে তারা বায়োটেকনোলজি পণ্য উৎপাদনে কাজ শুরু করবে। আরেক প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান বিজনেস অটোমেশন কিয়স্কসহ ডাটা সফট আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস) যন্ত্রাংশ তৈরি শুরু করেছে। এ ছাড়া সোনার বাংলা ফাউন্ডেশন কিডনি ডায়ালিসিসের যন্ত্রপাতি উৎপাদন করছে। বঙ্গবন্ধু সিটিতে কারখানা স্থাপনে সম্প্রতি কোরিয়ার বিখ্যাত অটোমোবাইল ব্র্যান্ড হুন্দাই ছয় একর জমি নিয়েছে।
অন্যদিকে, রাজধানীর কারওয়ান বাজারের জনতা টাওয়ারকে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে রূপান্তর করা হয়েছে। সেখানে ১৫টি প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। স্টার্ট-আপদের জন্য বিশেষ বরাদ্দের ফ্লোর রাখা হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রামে তৈরি হচ্ছে চট্টগ্রাম সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্মিত সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক মার্কেটের ৬-১১ তলা নির্মাণ করে তৈরি হচ্ছে চট্টগ্রাম সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক। এরই মধ্যে পার্কটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। রাজশাহীর পবার নবীনগরে গড়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্ক। ৩১ একর জমিতে দুই লাখ বর্গফুটের মাল্টিপারপাস ভবন নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। প্রকল্পের কাজ শেষ হবে এ বছরের জুন মাসে। রাজশাহীর শেখ কামাল আইটি ইনকিউবেটর এন্ড ট্রেনিং সেন্টারে ১০টি প্রতিষ্ঠানকে ১৫ হাজার ৬৪২ বর্গফুট রেডি স্পেস বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
সিলেটেও পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেলে ১৬২.৮৩ একর জমিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্ক নির্মাণ করছে সরকার। এই পার্ককে বিশেষায়িত ইলেকট্রনিক সিটি হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এখানে সাতটি প্রতিষ্ঠানকে ১৫ হাজার ৭৬০ বর্গফুট রেডি স্পেস এবং ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ৭২ দশমিক শূন্য ছয় একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর। যশোরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর চালু হয়েছে। অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে এই পার্কে।
হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, এখন অবধি হাইটেক পার্কগুলোতে জমি ব্যবহারের জন্য ১৪৩টি স্থানীয় স্টার্টআপ কোম্পানি নির্বাচন করা হয়েছে। এর মধ্যে কারওয়ান বাজারের জনতা টাওয়ারে ১২টি, যশোরে শেখ হাসিনা টেকনোলজিতে ২৩টি, সিলেটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পার্কে ১৩টি, রাজশাহীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্কে ৩০টি, নাটোরে কামাল আইটি ট্রেনিং এন্ড ইনকিউবেশন সেন্টারে ১০টি, চট্টগ্রামে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে ২৮টি এবং চুয়েটে শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং এন্ড ইনকিউবেশন সেন্টারে ৪০টি কোম্পানি রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুতের নিশ্চয়তা, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে একগুচ্ছ শুল্কমুক্ত সুবিধার কারণে এসব প্রযুক্তি পার্কে বিনিয়োগে ব্যাপক আগ্রহী উদ্যোক্তারা।
সরকার দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হাইটেক পার্কগুলোতে বিশেষ প্রণোদনা সুবিধা দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ১০ বছর কর মওকুফ, পার্ক ডেভেলপারের জন্য ১২ বছর পর্যন্ত কর মওকুফ, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি শুল্ক মওকুফ, প্রতিটি হাইটেক পার্ককে ওয়্যারহাউস স্টেশন হিসেবে বিবেচনা করাসহ নানা সুবিধা। এ জন্য কমপক্ষে এক কোটি ডলার বা প্রায় ৮৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। পার্কে বরাদ্দ পাওয়া প্লটের ভাড়া হিসেবে বছরে প্রতি বর্গমিটারে দুই ডলার করে দিতে হবে কম্পানিগুলোকে।
এদিকে, চুক্তির আওতায় আগামী ৪০ বছরের জন্য বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে বিনিয়োগের সুযোগ পেয়েছে দেশের বৃহত্তম প্রযুক্তি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, টেকনোমিডিয়া লিমিটেড, ড্যাফোডিল কম্পিউটারস লিমিটেড, সেলট্রোন ইলেক্ট্রো ম্যানুফ্যাকচারিং সার্ভিস লিমিটেড, উল্কাসেমি প্রাইভেট লিমিটেড, ম্যাকটেল লিমিটেড, চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন, শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, যশোরে রেডডট ডিজিটাল লিমিটেড ও ফেলিসিটি বিগ ডাটা লিমিটেড। এছাড়া হালিমা টেলিকমকে বেসরকারি সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক ঘোষণার অনুমতিপত্র আনুষ্ঠানিক ভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে। গেল ৩০ সেপ্টেম্বর ৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (সচিব) হোসনে আরা বেগম বলেন, আমরা হাইটেক পার্কে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পেরেছি। বড় বড় দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কম্পানির বিনিয়োগে এসেছে। অনেকেই কাজ শুরু করে দিয়েছে। যার ফলে এখানে অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ বলছে, তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের জন্য আন্তর্জাতিক মানের অবকাঠামো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিনিয়োগের অনুকূল ও টেকসই পরিবেশ উন্নয়ন করেই হাইটেক শিল্পের ইকোসিস্টেম তৈরি হয়েছে। হাইটেক সেক্টরে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত বিনিয়োগ অবকাঠামো এবং দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিয়ে আসাই তাদের মূল লক্ষ্য।
আনন্দবাজার/শহক