জিলফুল মুরাদ শানু
গত মার্চ থেকে বিশ্বব্যাপি করোনা ভাইরাস শুরুর পর থেকে জনমনে যেসব খাতে সবচেয়ে বেশি আতংক দেখা দিয়েছে তার মধ্যে স্বাস্থ্য সেবা খাত অন্যতম। দেশের মানুষ অনুপাতে চিকিৎসা কেন্দ্রের অপ্রতুলতা, চিকিৎসকের অপর্যাপ্ততা, চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকের অনিহা চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তির সুযোগকে সীমিত করেছে। বিশেষ করে নারী ও কিশোরীদের স্বাভাবিক বা নিয়মিত যৌন ও প্রজনন চিকিৎসা সেবা ও পরামর্শ পাওয়ার পথকে সংকুচিত করেছে বলে অভিযোগ এসেছে।
নারী ও কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন সেবা পরিস্থিতি: নববিবাহিত, গর্ভবতী অথবা সদ্যপ্রসূত মায়েদের মধ্যে যাদের পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির চাহিদা রয়েছে, প্রসবপূর্ব ও প্রসব পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন রয়েছে তাঁরা কভিড-১৯ প্রভাবিত হতে পারেন। বাংলাদেশের হাজারো নারী ও বিবাহিত কিশোরীরা দেশের ‘স্বাভাবিক’ পরিস্থিতিতেই যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক নানাবিধ সংকটের মধ্যে বেঁচে থাকে, বিশেষ করে যারা শহরের বস্তি এলাকা ও গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে। তাছাড়া যেসমস্ত গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের পরিস্থিতি কি হতে পারে তা এখন পর্যন্ত অনুমাননির্ভর। কভিড-১৯’র মত রোগের আকস্মিক আবির্ভাব বাংলাদেশের নারীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য’র ক্ষেত্রে নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা ও সংকটের মুখোমুখি করেছে। কভিড-১৯ এর মত জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রস্তুতিহীন স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হতে পারে এবং তার নজির ইতিমধ্যেই সংবাদমাধ্যমে আসতে শুরু করেছে। অন্যদিকে কোয়ারেন্টাইন, সামাজিক দূরত্ব, গণপরিবহন ব্যবহার ও চলাচলের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রস্তুতিহীনতা, স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় জনবল, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব প্রভৃতি নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের উপর বিস্তৃত পরিসরে প্রভাব ফেলতে সক্ষম। এদের অনেকেরই হয়তো যে কোন পদ্ধতি গ্রহণের পূর্বে একজন স্বাস্থ্যকর্মী অথবা চিকিৎসকের কাছ থেকে বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা থাকে, যেমন- কি কি ধরণের জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি রয়েছে। কোন কোন পদ্ধতি তাদের জন্য মানানসই। এসমস্ত পদ্ধতি কোথায় পাওয়া যায়। অন্যদিকে কিছু নারীদের পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে। অনেকেই হয়তো কোন একটি পদ্ধতি ব্যবহার করছেন কিন্তু পদ্ধতিটি তাদের শরীরে মানাচ্ছে না। কোন পদ্ধতিটি তাদের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সে বিষয়ে জানেন না। অনেকেই সম্প্রতি বাচ্চা প্রসব করেছেন অথবা যাদের এক বা একাধিক সন্তান বর্তমান তারাই বা কি ধরণের পদ্ধতি গ্রহণ করবেন। অনেকেই হয়তো কোন একটি দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতির মধ্যে রয়েছেন কিন্তু সেটি শরীরে অসুবিধার সৃষ্টি করছে সে বিষয়ে স্বাস্থ্যকর্মীর সাথে আলোচনা করতে চান অথবা খুলে ফেলতে চান। কেউ কেউ স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহন করতে চাইতে পারেন। কারো কারো মাসিক নিয়মিতকরণ এমনকি গর্ভপাত করার প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্বের বাধ্যবাধকতায় উপরের যে কোন সমস্যাই প্রকট হয়ে উঠতে পারে অর্থাৎ নারীরা অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ করে ফেলতে পারেন এবং এর দরুণ অন্যান্য সামাজিক সমস্যার মুখোমুখী হতে পারেন এইসব সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে।
করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা; বিশেষ করে চিকিৎসক ও নার্সরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, পুরো পৃথিবীতে স্বাস্থ্যসম্পর্কিত কাজে নিয়োজিত লোকবলের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী। চীনের হুবেই প্রদেশে (যেখান থেকে কোভিড-১৯-এর উদ্ভব বলে ধারণা করা হচ্ছে) স্বাস্থ্যকর্মীদের ৯০ শতাংশই নারী। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় হিসাব অনুযায়ী, সে দেশে স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে নারী ৭৬ শতাংশ। আমাদের দেশেও এই সংখ্যা কম হবে না। ফলে যে রোগের এখনো কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি, সেই রোগের ক্ষেত্রে বিশাল ঝুঁকির মুখে রয়েছে এই খাতের নারীরা। কর্মজীবী নারীদের নিয়ে কাজ করে এলিভেট নেটওয়ার্ক নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এর প্রধান নির্বাহী ক্রিস্টি ওয়ালেস বলেন, ‘একটি পরিবারে নারীদের সাধারণত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, প্রধান বিনোদন কর্মকর্তা ও প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা এই তিন ধরনের কাজই করতে হয়। সংকটকালে যখন আমরা কী করব বুঝে উঠতে পারি না এবং আতঙ্কগ্রস্ত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি, তখন এতগুলো ভূমিকা পালন করা নারীদের জন্য অসহনীয় হয়ে ওঠে।’
নারী ও কিশোরীর মানসিক স্বাস্থ্যসেবাও ব্যাহত: জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (এনআইএমএইচ) সাধারণ মানসিক অসুস্থতাগুলোর লক্ষণ বুঝতে এ বছর দুটি এলাকায় এক জরিপ চালায়। এতে দেখা যায়, নারী-পুরুষনির্বিশেষে জরিপে অংশগ্রহণকারী লোকজনের ৩৩ শতাংশ বিষণœতা, উদ্বেগ, শুচিবাই, সিজোফ্রেনিয়া বা অন্য কোনো মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন। তবে নারীদের মধ্যে এই হার বেশি। তাঁদের ৩৭ শতাংশ এমন অন্তত একটি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। পুরুষদের মধ্যে এমন সমস্যা রয়েছে ২৭ শতাংশের।মাসিকের সময়, গর্ভধারণের সময়ে, প্রসবের পর ও মেনোপজ বা মাসিক বন্ধ হওয়ার সময়ে মেয়েদের বিষণ্নতাসহ নানা রকম মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। কাটিয়ে ওঠার ব্যবস্থা না নিলে, পরে সেগুলোই মানসিক রোগ ডেকে আনে। এভাবে পুরুষের তুলনায় নারীদের মানসিক অসুস্থতা বেশি হতে দেখা যায়। নারীরা সাধারণত বিষণœতা, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, হিস্টিরিয়া বা স্মরণশক্তি কমে যাওয়ার মতো সমস্যায় বেশি ভোগেন। প্রজননচক্রের প্রভাব তো আছেই। মেয়েদের থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যাও বেশি হয়, যা থেকে এ ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
হাসপাতালের চিত্র: মোহাম্মদপুরের একজন বাসিন্দা সাহিদা আক্তার। সাড়ে তিন মাসের গর্ভবতী। কয়েকদিন ধরে জ্বর, সর্দি-কাশিতে ভুগছিলেন। অন্যকোনো সমস্যা ছিলো না। চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে গেলে প্রথমে চিকিৎসক তাকে দেখতেই রাজী হননি। তাকে পরামর্শ দেওয়া হয়, তিনি যেন আইইডিসিআরের হটলাইনে যোগাযোগ করে করোনাভাইরাসের পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন। তিনি বলেন তার রোগ করোনার লক্ষণের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, তাই এখানে চিকিৎসা করাবে না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত আতঙ্ক আর অবহেলায় একজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে সম্প্রতি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, কানাডা ফেরত একজন ছাত্রী পেটের ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। প্রথমে তার চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু যখনি ডাক্তার ও সেবিকারা জানতে পারেন যে, তিনি কানাডা থেকে এসেছেন, এরপর তার কাছে আর কোনো চিকিৎসা কর্মী আসেননি বলে পরিবার অভিযোগ করেছে।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য: আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ”আমরা এই ধরণের তথ্য পাচ্ছি, প্রকাশ্যেই দেখতে পাচ্ছি যে, এই ধরণের বিষয়গুলো হচ্ছে। অনেকদিন ধরেই এই সমস্যা হচ্ছে, আমরা বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। সমস্যাটি সমাধান করার জন্য আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করছি।”
পরামর্শ: কভিড-১৯ মহামারীর মাধ্যমে বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গীয় এবং সম্পদের অভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা তৈরি হচ্ছে। আয়ের পথ বন্ধ হওয়া, দারিদ্র, ক্ষমতাহীন হওয়া, অসহিষ্ণুতা এই বিষয়গুলো মোটামুটিভাবে নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং এ-বিষয়ক অধিকারের ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসাবে কাজ করে। মানবাধিকার বিষয়ক নীতিমালা আমাদেরকে এব্যাপারে করণীয় কি তা ঠিক করতে সাহায্য করতে পারে। বিশেষ করে, মহামারি রেসপন্সের ক্ষেত্রে জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও সমতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে; স্বাস্থ্য সেবার প্রাপ্যতা, সহজলভ্যতা, এবং মান নিশিচতকরণের মাধ্যমে; স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে। আমাদেরকে এসময় বৈশ্বিক উদাহরণ থেকে প্রতিনিয়ত শিক্ষা নিতে হবে যে কিভাবে বৈশ্বিক সহযোগিতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সমন্বিতভাবে এই সমস্যাকে মোকাবিলা করা যায়। তবে সেক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর সদিচ্ছা।