পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নিজেরে ৫৭টি মুসলিম দেশের জোট ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের দুদিনের এক বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে যাতে ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলকে তীব্র নিন্দা করা হয়েছে।
এমনকি গত বছর পাঁচই অগাস্টের ঐ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্যও ভারতকে আহ্বান জানানো হয়েছে। একই সাথে ভারত-শাসিত কাশ্মীরে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে ওআইসির প্রস্তাবে।
কাশ্মীরে “ভুয়া এনকাউন্টারে” করে আইন বহির্ভূত হত্যা, “তল্লাশি ও ঘেরাও” অভিযান এবং শাস্তির কৌশল হিসাবে কাশ্মীরিদের বাড়ি-ঘর এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি গুঁড়িয়ে দেওয়া, সাধারণ মানুষের ওপর ‘পেলেট‘ বুলেট ছোড়া এবং “ভারতীয় সৈন্যদের হাতের কাশ্মীরি নারীদের হেনস্থার“ নিন্দা করা হয়েছে।
ভারত যেভাবে কাশ্মীরে “আন্তর্জাতিক এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করছে, আন্তর্জাতিক প্রস্তাব অগ্রাহ্য করছে” তার বিবেচনায় ভারতের সাথে সম্পর্ক “পুনর্বিবেচনা” করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ওআইসির প্রস্তাবে।
ওআইসি আবারও বলেছে কাশ্মীর একটি অমীমাংসিত ইস্যু এবং “নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণে কাশ্মীরিদের অধিকারের বিষয়টি জাতিসংঘের এজেন্ডাতে থাকলেও গত ৭০ বছর ধরে অমীমাংসিত রয়ে গেছে।”
ভারতের ক্ষোভ :
কিন্তু ভারত সরকার তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। ওআইসির প্রস্তাব নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যে বিবৃতি জারী করা হয়েছে তার ভাষা খুবই শক্ত।
ভারতের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “কেন্দ্র শাসিত জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং আমরা সব সময় বলেছি ভারতের যে কোনো অভ্যন্তরীণ ইস্যু নিয়ে কথা বলার কোনো এখতিয়ার ওআইসির নেই।”
ভারত সরকারের বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ওআইসির প্রস্তাবে ভারতকে নিয়ে যেসব কথা বলা হয়েছে তা “তথ্যগত-ভাবে ভুল এবং অনভিপ্রেত“ ফলে ঐ সব বক্তব্য ভারত “পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করছে।”
দিল্লিতে বিবিসির বাংলার শুভজ্যোতি ঘোষ বলেন, ভারত সরকার ক্ষুব্ধ, কিন্তু সেইসাথে ওআইসির এই বিবৃতিতে কিছুটা বিস্মিত এবং বিব্রত। তিনি বলেন, ভারত আশা করেছিল কাশ্মীর নিয়ে ওআইসির বৈঠকে কোনো বিবৃতি আসবে না কারণ এটি বৈঠকের এজেন্ডাতেই ছিল না।
“সে কারণে এই বিবৃতি ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তরের কাছে কিছুটা অপ্রত্যাশিত ছিল। কর্মকর্তারা কিছুটা বিব্রতও বটে কারণ তারা মনে করেন ওআইসি জোট কী বললো না বললো তার কিছুটা প্রতীকী গুরুত্ব তো রয়েছেই।”
শুভজ্যোতি ঘোষ বলেন, ভারতের কূটনীতিকরা মনে করেন সৌদি আরব বা ইউএই‘র সাথে তাদের এখন যে সম্পর্ক তাতে মুসলিম এবং আরব বিশ্ব থেকে কাশ্মীর নিয়ে তেমন কোনো চাপ আসবে বলে তারা মনে করেন না।
উল্লসিত পাকিস্তান :
এদিকে পাকিস্তানের সরকারি নেতারা গত দুদিনে বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে এটিকে তাদের একটি কূটনৈতিক সাফল্য হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। পাকিস্তানের মিডিয়াতেও ওআইসির এই প্রস্তাবের খবর ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে।
ডনের মত দায়িত্বশীল এবং নিরপেক্ষ দৈনিকও সোমবার তাদের এক সম্পাদকীয়তে লিখেছে, “সুখবর এটাই যে ওআইসি বৈঠকের এজেন্ডাতে কাশ্মীর না থাকলেও মনে হচ্ছে পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কূটনৈতিক সাফল্য অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে।”
পাকিস্তান গত বছরের অগাস্ট মাস থেকেই কাশ্মীর নিয়ে বিশেষ একটি বৈঠকের জন্য ওআইসির ওপর চাপ দিচ্ছিল। তবে প্রধানত সৌদি আরবের আপত্তির কারণে তা যে সম্ভব হচ্ছিল না তা গত মাসগুলোতে পাকিস্তানের সরকারি নেতাদের বিভিন্ন বক্তব্যে তা পরিষ্কার বোঝা গেছে।
এমনকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিজে ফেব্রুয়ারিতে তার মালয়েশিয়া সফরে গিয়ে তার অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। পাকিস্তানর পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোলাখুলি সৌদি আরবের সমালোচনা করে হুমকি দিয়েছে তারা তুরস্ক এবং আরো কিছু দেশকে নিয়ে বিকল্প একটি মুসলিম জোট তৈরির সম্ভাবনা নিয়ে ভাবছেন।
পাকিস্তানের মিডিয়াতে ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে, পাকিস্তানের দেন-দরবারের মুখেই হয়ত সৌদি আরব তাদের অবস্থান কিছুটা নমনীয় করেছে।
ওআইসি বৈঠকে পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলের সদস্য এবং পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরের প্রেসিডেন্ট মাসুদ খান টুইট করেন – শুক্রবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তুরস্ক, নিজের এবং পাকিস্তান কাশ্মীর ইস্যু উত্থাপন করে, এবং কাশ্মীর সমস্যার সমাধান ছাড়া এই অঞ্চলে শান্তি সম্ভব নয় বলে পাকিস্তানের বক্তব্য সমর্থন করেন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী।”
ওআইসির বিবৃতির গুরুত্ব কতটা :
- কিন্তু ওআইসির একটি বিবৃতির কতটা গুরুত্ব আসলে রয়েছে?
- পাকিস্তানের জন্য এটি কত বড় অর্জন?
- কাশ্মীর নিয়ে কতটা চাপে পড়বে ভারত?
বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন মনে করেন, জোট হিসাবে ওআইসির গুরুত্ব এবং প্রভাব এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে কম।
“মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ঐক্যের চেয়ে অনৈক্য-অমিল এখন অনেক বেশি। এক দেশের সাথে আরেক দেশের প্রচণ্ড শত্রুতা। ফলে এমন সব দেশের মধ্যে যে কোনো জোট গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।”
তিনি বলেন বিবৃতি বা শুধু কথা দিয়ে কোনো কাজ হয়না। তিনি উদাহরণ দেন – “বিশ্বের বহু দেশই চায় রোহিঙ্গাদের যেন মিয়ানমার ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু এ নিয়ে তারা মিয়ানমারের ওপর কোনো চাপ প্রয়োগ করছে না। ফলে তেমন কিছুই হচ্ছে না…কাশ্মীর নিয়ে ওআইসির বিবৃতিও তেমনি বিবৃতির মধ্যেই থেকে যাবে বলে আমি মনে করি। আগেও তাইই হয়েছে।”
মি. হোসেন মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে যে ধরণের মেরুকরণ, দলাদলি চলছে তাতে কাশ্মীর বা কাশ্মীরের মুসলিমদের নিয়ে কোনো বহু মুসলিম দেশের মাথাব্যথা নেই।
“সৌদি আরব, ইউএই বা অনেক আরব দেশের কাছে পাকিস্তানের চেয়ে ভারতের গুরুত্ব এখন অনেক বেশী। তাদের কাছে ভারতের বাজারের গুরুত্ব কাশ্মীরের মুসলিমদের চেয়ে অনেক বেশি”
“পাকিস্তান ওআইসির সদস্য। সুতরাং জোটের প্রস্তাবে পাকিস্তানের দাবি-দাওয়া প্রতিফলিত হতেই পারে। সৌদি আরব হয়ত চাপাচাপির কারণে পাকিস্তানকে কিছুটা ছাড় দিয়েছে। কিন্তু তাতে বাস্তব অবস্থার কোনো বদল হবে বলে আমি মনে করি না।”
খবর : বিবিসি বাংলা।
আনন্দবাজার/এম.কে