ঢাকা | বৃহস্পতিবার
১২ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিরান পথে হেঁটে গেলেন সঞ্জীব চৌধুরী

“পাগল রাগ করে চলে যাবে ফিরেও পাবে না, পাগল কষ্ট চেপে চলে যাবে ফিরেও আসবে না” সঞ্জীব চৌধুরীর এ দুটি লাইন পড়লে মনে হয়, চলে যাবার আগেই যেন তিনি না ফেরার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।

আজ সেই সংগীতশিল্পী, গীতিকবি ও সাংবাদিক সঞ্জীব চৌধুরীর ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী।

২০০৭ সালের ১৮ নভেম্বর রাত ১২.১০ মিনিটে (অর্থাৎ ১৯ নভেম্বর) অ্যাপোলো হাসপাতালে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে মারা যান এ বিপ্লবী ও প্রতিভাবান শিল্পী। দেখতে দেখতে ১৩ বছর কেটে গেছে তার প্রস্থানের। ব্যান্ডদল ‘দলছুট’র প্রতিষ্ঠাতা ও অন্যতম প্রধান সদস্য ছিলেন তিনি।

সঞ্জীব চৌধুরী ও বাপ্পা মজুমদার দুজনে মিলে তৈরি করেছিলেন ‘দলছুট’ ব্যান্ডের অ্যালবামগুলো: ‘আহ্’ (১৯৯৭), ‘হৃদয়পুর’ (২০০০), ‘আকাশচুরি’ (২০০২) ও ‘জোছনা বিহার’ (২০০৭)। এরপর আয় আমন্ত্রণসহ আরও অ্যালবাম বেরিয়েছে এই ব্যান্ড থেকে। এর মধ্যে ‘স্বপ্নবাজি’ ছিলো সঞ্জীব চৌধুরীর একক অ্যালবাম।

২০০৭ সালে প্রকাশিত ‘টুকরো কথা’ অ্যালবামটি সঞ্জীবের মৃত্যুর পর তার প্রতি শ্রদ্ধার্থে প্রকাশ পায়। এতে তার লেখা কবিতাগুলোর সংকলন ছিল। এছাড়া ‘আয় আমন্ত্রণ’ হচ্ছে ব্যান্ডটি ষষ্ঠ ও সর্বশেষ অ্যালবাম।

২০১০ সালের ২৫শে ডিসেম্বর সঞ্জীব চৌধুরীর ৪৭তম জন্মদিনে ‘সঞ্জীব উৎসব’ পালনের মধ্য দিয়ে এই অ্যালবামটি প্রকাশ পায়। এই অ্যালবামের ‘নতজানু’ নামে সর্বশেষ গানটি সঞ্জীব চৌধুরী নিজেই লিখেছিলেন।

সঞ্জীব চৌধুরী ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার মাকালকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা গোপাল চৌধুরী ও মা প্রভাষিনী চৌধুরীর নয় সন্তানের মধ্যে সঞ্জীব ছিলেন সপ্তম।

১৯৮০ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে মেধাতালিকায় স্থান করে নেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা শেষ না করে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে ফিচার বিভাগ চালু করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল সঞ্জীব চৌধুরীর। নব্বইয়ের দশকের আগে সকল সংবাদপত্র ভর্তি ছিলো শুধু সংবাদ আর সংবাদে। তার এই পদক্ষেপে সংবাদপত্রের কাটতি নাটকীয়ভাবে বেড়ে যেতে থাকে।

সঞ্জীবের গানে গানেও ভেসে উঠতো এক স্বপ্নসন্ধানের অনুভূতি। তিনি স্বপ্নের পাখি ধরবার এক অভিলাষ ব্যক্ত করতেন –

“আমি ঘুরিয়া ফিরিয়া সন্ধান করিয়া,
স্বপ্নের অই পাখি ধরতে চাই,
আমার স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই
আমার অন্তরের কথা বলতে চাই”

আবার, সোডিয়াম বাতির নিচে মাঝরাতে গীটার হাতে কোনো তরুণ হয়তো হঠাৎ গেয়ে ওঠে, “আমি তোমাকেই বলে দেবো…আমি তোমাকেই বলে দেবো সেই ভুলে ভরা গল্প, কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরজায়/ ছুঁয়ে কান্নার রং, ছুঁয়ে জ্যোছনার ছায়া”।

তিনি সবসময়ই চাইতেন মানবকল্যাণে নিজেকে কাজে লাগাতে, সংস্কারবোধের উপরে উঠে সঞ্জীব চৌধুরী একজন মানুষ হবার আশা রাখতেন এবং মানবতারই গান গাইতেন তার গীটারের তারে তারে।

মৃত্যুর পরও বিজ্ঞান তথা চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতি রেখে গেলেন শেষ অবদান- তার দেহটি। আজও ঢাকা মেডিকেল কলেজে তার কঙ্কালটি চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়ুয়া ছাত্রদের পড়ার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। কোনো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নয়, নয় কোনো শেষ সমাধি।

বাংলাদেশের বিপ্লবী তরুণসমাজের কণ্ঠে আজও বেঁচে আছেন তিনি, বেঁচে থাকবেন দলছুটের দলনেতা হয়ে। সঞ্জীব চৌধুরী তার মেয়ের নাম দিয়েছিলেন কিংবদন্তী। একজন কিংবদন্তীর পিতা হয়ে আজও রয়ে গেছেন সবার মাঝে।

সত্যিকার কর্মীব্যক্তি ছিলেন সঞ্জীব চৌধুরী। অনেকের কাছেই ৪৩ বছর বয়সটা খুব কম মনে হবে, কিন্তু সেই যে কথাটি- “মানুষ বাঁচে তার কর্মের জন্য, বয়সের জন্য নয়”।

সূত্র : রোর

আনন্দবাজার/ইউএসএস

সংবাদটি শেয়ার করুন