গত ৩১ মে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে কিডনি ও হার্টের রোগী গাজী সাবিহা চৌধুরী (৭০) গোসলখানায় যখন পড়ে যান তখন তার পরিবার আতঙ্কিত হয়েছিলেন এই ভেবে যে, এখন দুর্ভাগ্যজনক কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
সাথে সাথে তাকে শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্যে মৌলভীবাজার জেলার ২৫০-শয্যা হাসপাতালে রেফার করেন।
তবে, সেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানকার চিকিৎসকরা তার আইসিইউ সাপোর্ট লাগবে বলে দ্রুত সিলেটে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেন।
উদ্বিগ্ন পরিবার রোগীকে দ্রুত সিলেটের নিয়ে যান। সেখানে সাতটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চেষ্টা করেন। তবে, কোনো হাসপাতালই তাকে ভর্তি করাতে পারেননি । প্রথমে বলেছিল, তাদের আইসিইউ বেড খালি নেই অথবা, আগে রোগীর করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট দেখাতে হবে।
পরে সাবিহা সেদিনই মারা যান।
গত মঙ্গলবার সাবিহার এক আত্মীয় জানান, ‘আমরা আইসিইউ বেডের জন্যে কতো আকুতি-মিনতি করলাম, কেউ আমাদের সাহায়তা করল না। রোগীর যখন অক্সিজেন দরকার ছিল, তখন দুটি হাসপাতাল অক্সিজেন সিলিন্ডার দিতেও অস্বীকার করে।’
সাবিহার এই করুণ কাহিনী কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এমন আরও অনেক ঘটনা আছে। গণমাধ্যমের রিপোর্টে গেছে, আইসিইউয়ের অভাবে সংকটাপন্ন করোনা রোগীদেরকেও দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। তাদের কেউ কেউ আবার মারাও গেছেন।
এই যখন অবস্থা তখন সরকারি তথ্যে দেখা যায়, করোনা রোগীদের জন্যে নির্দিষ্ট করা বিভিন্ন হাসপাতালে বেশ কিছু আইসিইউ বেড খালি পড়ে রয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের হিসাবে, সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ১০৬টি হাসপাতালে ৩৭৯টি আইসিইউ বেড ও ১০৬টি ডায়ালেসিস বেড আছে। এসব হাসপাতালে ১৪ হাজার ৬১০ জন করোনা রোগীর চিকিৎসা হতে পারে।
অধিদপ্তরের হিসাবে অনযায়ী, গত ৬ জুন থেকে ২৫ জুন পর্যন্ত দৈনিক গড়ে ৭৮টি আইসিইউ বেড ব্যবহৃত হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, গত ১১ জুন সবচেয়ে বেশি ৯৯টি বেড ব্যবহৃত হয়েছে। সবচেয়ে কম ৪১টি বেড ব্যবহৃত হয়েছে ২২ জুন।
অধিদপ্তরের অপর তথ্যে বলা হয়েছে, গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সারা দেশে ১৭৭ রোগী আইসিইউ বেডে ছিলেন।
এতে আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে সারা দেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতে মোট ৭৪৯টি আইসিইউ বেড আছে। সেগুলোর মাঝে ১৯০ বেড ১৭টি সরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্যে স্থাপন করা হয়েছে।
বিভিন্ন সমীক্ষায় জানা যায়, করোনা আক্রান্তদের প্রায় ২০ শতাংশের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। এসব রোগীদের সাধারণত অক্সিজেন থেরাপি প্রয়োজন হয়। যাদের অবস্থা সংকটাপন্ন শুধু তাদেরই আইসিইউ’র দরকার।
স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের মতে, গতকাল পর্যন্ত মোট ৪ হাজার ৬৫২ রোগী সেসব হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।
জনবলের অভাব
অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতে, আইসিইউ বেডগুলো খালি থাকার প্রধান কারণ হচ্ছে প্রশিক্ষিত লোকবলের অভাব।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের কথা। লোকবলের অভাবের ফলে এই হাসপাতালটির ২৬টি আইসিইউ বেডের সবগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে না।
এই হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট ডা. শিহাব উদ্দিন জানান, ‘এখানে এখন পর্যন্ত যে সংখ্যক জনবল রয়েছে তা দিয়ে ১৬টি আইসিইউ বেড ব্যবহার করা যাচ্ছে।’
তিনি আরও জানান, ‘একটি আইসিইউ বেডের জন্যে একজন ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিকেল স্পেশালিস্টের দরকার। তবে, দেশে এ রকম স্পেশালিস্টের ব্যাপক সংকট।’
তার মতে, দেশে ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিকেল স্পেশালিস্ট আছেন মাত্র ১৩ জন।
‘যদিও অ্যানেসথেসিওলজিস্টকে দিয়ে আইসিইউ চালানো যায়, তাদের সংখ্যাও খুব কম,’ যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও জানান, ‘আমরা আইসিইউয়ের জন্যে দরকারি লোকবল খুঁজছি। কিন্তু, সমস্যা হলো এই ফিল্ডে প্রশিক্ষিত লোকের মারাত্তক অভাব।’
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বাস্তবতা হচ্ছে— দেশের সব আইসিইউ বেড ব্যবহৃত হচ্ছে না।
তারা মনে করেন, করোনা হাসপাতালগুলোতে কতগুলো আইসিইউ বেড খালি আছে সে সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই বলে আইসিইউ বেড পেতে মানুষের এত কষ্ট হচ্ছে।
আইসিইউ বেডগুলোর মধ্যে ঢাকার করোনা হাসপাতাল ও অন্যান্য হাসপাতালের করোনা ইউনিটের জন্যে রয়েছে ২১৮টি। বাকিগুলো দেশের অন্যান্য স্থানে।
করোনা মোকাবিলায় জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘যদি বেডগুলোর গড় ব্যবহার ৭৮ শতাংশ হয়, তাহলে এই সময় কেন এত মানুষ আইসিইউ সাপোর্ট পাচ্ছেন না? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এর পরিষ্কার জবাব দিতে হবে।’
১৮ এপ্রিল গঠনের পর থেকেই কমিটি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ সুবিধা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে আসছিলেন।
অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সময়ের অভাবে এসব হাসপাতালে কয়েকটি আইসিইউ বেড সঠিকভাবে স্থাপন করায় সেগুলোকে এখনো ব্যবহার উপযোগী করা যায়নি।
গত ২০ জুন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে এক চিঠিতে আইসিইউগুলো ‘সঠিক উপায়ে’ স্থাপন করা হয়নি বলে উল্লেখ করেছে।
তাছাড়াও, নির্দিষ্ট সংখ্যক আইসিইউ বেডগুলো ভিআইপিদের জন্যে রাখা আছে বলেও জানান নাম প্রকাশ না করা এক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।
গত ১৫ জুন প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সমীক্ষায় জানানো হয়েছে, সেসব হাসপাতালে ১৪০টির কম আইসিইউ কার্যকর দেখা গেছে।
কোথায় কোথায় করোনা রোগীদের জন্যে বেড খালি রয়েছে তা সবাই যাতে জানতে পারে সে জন্যে স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরকে সেই তথ্য অনলাইনে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে জাতীয় কারিগরি কমিটি।
গতরাত পর্যন্ত তা অনলাইনে দেখা যায়নি।
কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ জানান, ‘গত এপ্রিল থেকে আমরা বলছি আইসিইউ বেডগুলো সম্পর্কে তথ্য সবাইকে জানানোর ব্যবস্থা করতে। তা এখনো বাস্তবায়ন করা হলো না।’
এ ব্যাপারে অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম ইউনিটের পরিচালক ডা. হাবিবুর রহমান জানান, ‘এগুলো হচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি করোনা হাসপাতালগুলোর প্রতিদিনের হিসাব। আসলে প্রায় ২০ শতাংশ হাসপাতালে তথ্য নিয়মিতভাবে হালনাগাদ করা হয় না।’
স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ জানান, ‘যেসব হাসপাতালে আইসিইউ বেড খালি আছে রোগীরা হয়তো সেসব হাসপাতালে যাচ্ছেন না।’
‘মাঝেমধ্যে আমাকে জিজ্ঞাস করা হয়, রোগীরা কেন হাসপাতালে বেড পাচ্ছেন না। অথচ আমি দেখছি বেড খালি রয়েছে। তাহলে দেখতে হবে লোকজন আসলে কোন হাসপাতালে যাচ্ছেন, সেখানে আইসিইউ সুবিধা রয়েছে কিনা।’
অধ্যাপক আজাদ আরও জানান, ‘আইসিইউগুলো ঠিক মতো ব্যবহৃত হচ্ছে না— তা বলা ঠিক হবে না। করোনা হাসপাতালগুলোতে অনেক বেড ও আইসিইউ খালি রয়েছে। আমি জানি না মানুষ এসব বলছেন কেন।… কাউকে জোর করে আইসিইউতে ভর্তি করানো তো ঠিক কাজ হবে না।’
রোগীদের ‘জীবন বাঁচাতে’ এখন হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন দেওয়ার ব্যাপারটিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
আনন্দবাজার/এফআইবি