গাজীপুরের শ্রীপুরে জৈনাবাজার কাঁঠালের জন্য বিখ্যাত অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার কাঁঠালের উৎপাদন বেশি হয়েছে কিন্তু মহামারি করোনার কারণে বেশি দাম না পাওয়ায় কাঁঠাল চাষিরা বিপাকে। এ মৌসুমে শ্রীপুরের প্রতিটি বাড়িতে একাধিক কাঁঠাল গাছ দেখা যায়। কিন্তু শিল্প-কারখানার প্রসার ও নগরায়নে প্রতিনিয়তই কমছে কাঁঠাল চাষের সংখ্যা। যে পরিমাণে গাছ কাটা হয়েছে সেই পরিমাণে গাছ লাগানো হয়নি যার ফলে কাঁঠাল গাছ কমছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় কাঁঠাল ফল বিলীন হয়ে যাবে।
সোমবার (২২ জুন) সকালে জৈনা বাজারে কাঁঠাল বিক্রি করতে এসে নয়নপুর গ্রামের শামসুল হক জানান , মহামারি করোনা কারণে ঢাকা থেকে পাইকার না আসায় সেই বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় দিয়ে সকাল থেকে কাঁঠাল নিয়ে নিয়ে বসে আছি কোন ক্রেতা নেই ৬০টি কাঁঠাল নিয়ে আসছি দাম বলেছে পাইকাররা সাতশত পঞ্চাশ টাকা । চিন্তাভাবনা করছি আর কাঁঠাল চাষ করব না এমন দাম থাকলে।
স্থানীয় কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, কাঁঠাল চাষের জন্য লালচে মাটির প্রয়োজন ও উঁচু চালা জমি উপযুক্ত। একসময় গাজীপুরের কৃষি অর্থনীতির চালিকাশক্তির কেন্দ্র ছিল কাঁঠালকে ঘিরেই। তাই গাজীপুরকে বলা হতো কাঁঠালের রাজ্য। তবে ১৯৯০ সালের পর থেকে উঁচু চালা জমিতে পর্যাপ্ত শিল্প-কারখানা গড়ে ফলে ওঠায় কাঁঠাল চাষে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে । অনেকেই কাঁঠাল চাষে নিরুৎসাহিত হয়ে চালা জমিতে কাঁঠাল চাষের পরিবর্তে বাড়ি-ঘর নির্মাণে ব্যস্ত।
গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জেলায় ১০ হাজার ৩৫৮ হেক্টর জমিতে কাঁঠাল চাষে উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৮৮ হাজার ১০ মেট্রিক টন। পরের অর্থবছরে চাষ হয় ৮ হাজার ৮৮১ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন হয় ২ লাখ ৫৩ হাজার ১৮ মেট্রিক টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে চাষ বেশি উৎপাদন হয় ৩লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাঁঠাল উৎপাদন হয় শ্রীপুরে। আর জেলার সবচেয়ে কম কাঁঠাল উৎপাদন হয় কালিয়াকৈর উপজেলায়। একসময় জেলার মধ্যে সবচেয়ে বড় কাঁঠালের বাজার ছিল শ্রীপুরের জৈনা বাজার। তবে কাঁঠাল চাষ কমে যাওয়ায় এখন জৈনা বাজারের আগের জৌলুস নেই।
গাজীপুরের কাঁঠালকে ঘিরেই একসময় দেশের সবচেয়ে বড় বাজার বসেছিল ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের জৈনা বাজার, মাওনা চৌরাস্তা, মাস্টারবাড়ী এলাকায়। কাঁঠালের মৌসুমজুড়ে বাজারগুলোতে হাঁকডাক চলতো। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা কাঁঠাল কেনার জন্য আসতেন। কিন্তু নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে কাঁঠালের চাষ কমে যাওয়ায় এখন কাঁঠালের বাজার আর আগের অবস্থানে নেই। পাইকাররাও এখন আর আসেন না।
বাজারের আড়ৎদার মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘গত ১০ বছর ধরে গাজীপুরে প্রতিনিয়ত কমছে কাঁঠাল চাষ। নতুনভাবে কেউ কাঁঠাল চাষে উৎসাহিত হচ্ছে না। ফলে এখন আগের মতো এ বাজারে কাঁঠাল আসে না।’উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়ন এর আব্দুল বাতেন বলেন, ‘কাঁঠাল চাষের প্রতিবন্ধকতা শিল্পায়ন ও ন্যায্য মূল্য না পাওয়া।
এছাড়া কাঁঠাল গাছ কেটে শিল্পপ্রতিষ্ঠান, বাড়ি-ঘর নির্মাণ করা হলেও নতুন করে লাগানো হচ্ছে না। এসব কারণে কাঁঠাল চাষ কমছে।’ তেলিহাটি ইউনিয়নের উদয় খালি গ্রামের নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বছর দশেক আগেও আশপাশের জেলায় আমরা কাঁঠালের চারা সরবরাহ করতাম। এখন আর কাঁঠালের চারার কোন চাহিদা নেই।’
আড়ৎদার কবির হোসেন জানান, আমি দশ থেকে বারো হাজার টাকা প্রতিদিন আড়তদাড়ি পেতাম বর্তমানে সরবরাহ কমে যাওয়ায় সারাদিনে পাঁচ শত টাকা ও আড়তদাড়ি পায়নি। এখন কাঁঠাল কেনাবেচা কমে যাওয়ায় আড়তদাড়ি খুব দুষ্কর হয়েছেপড়েছে।একদিকে শিল্পায়ন অপরদিকে খাবারের ভিন্নতায় সাধারণ মানুষের মধ্যে কাঁঠালে আগ্রহ কমছে। আবার দেশীয় পরিবেশের ভারসাম্য হারানোয় কাঁঠালের ফলনও কমছে। এবছর কাঁঠালের উৎপাদন বেশি হলেও ক্রেতার সংকট ও মহামারী করোনা কারণে কাঁঠাল চাষীরা বেশি দাম থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
আনন্দবাজার/শাহী/মহি