জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার প্রত্যয়, চাকরির দুষ্প্রাপ্যতা, বেকারত্ব দূরীকরণসহ দারিদ্রের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে জীবন যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার প্রবল ইচ্ছা নিয়ে রাঙ্গুনিয়ার বেকার যুবক মো. সোহেল একজোড়া তিতি পাখি দিয়ে শুরু করেন খামার।
আত্মপ্রত্যয় ও পরিশ্রমের মাধ্যমে সেই একজোড়া তিতি পাখি এখন হয়ে উঠেছে ৮০০ তিতি পাখির একটি খামার। আর এক সময়ের বেকার যুবক সোহেল হয়ে উঠেছেন একজন সফল খামারী ।
২০১৫ সালের প্রথম দিকে নিজের পৈত্রিক ভিটায় বাসস্থানের পাশে ছোট্ট একটি ঘরে তিতি পালন শুরুর বছর খানেক পর থেকেই আসতে শুরু করলো সফলতা। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলার ওয়াগ্গা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডর ডেকিকাটা ছড়া এলাকায় তার বাবার ৪ শতক পাহাড়ি ভূমিতে ” হাজি ইদ্রিস মাস্টার এগ্রো ফার্ম” নামে গড়ে তোলেন তিতি পাখির বিশাল খামার। সততা আর নিরলস পরিশ্রম দিয়ে সোহেল ঘুরিয়েছে নিজের ভাগ্যের চাকা। একই সাথে বদলে দিয়েছে স্থানীয় কয়েকজন বেকারের ভাগ্য।
সোহেল তার খামারে তিতি ছাড়াও পালন করছেন টার্কি ও হাইব্রিড কোয়েল ও কাদাকনাথ (চীনা মুরগী)। নিজের খামারের গাই বাচ্চা উৎপাদন করছেন বেশি। খামারে ১দিন বয়সের বাচ্চা থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক তিতি পাখি রয়েছে। যেগুলোর প্রতিটির ওজন প্রায় ৫-৬ কেজি উপরে। খামারের উৎপাদিত ডিম দিয়ে নিজস্ব হ্যাচারীতেই বাচ্চা উৎপাদন করে তা বিভিন্ন খামারীরদের কাছে বিক্রি করছেন তিনি।
আলাপকালে সোহরাব হোসেন বলেন, ‘চাকরির পেছনে ছুটতে গিয়ে অনেক সময় নষ্ট করেছি। ছোট-বড় অনেক ব্যবসা করেছি। কিন্তু সফলতা পায়নি। পরে নরসিংদী জেলা থেকে ১০টি তিতির বাচ্চা কিনে এনে নিজের পৈত্রিক ভিটায় বাসস্থানের পাশে ছোট্ট একটি ঘর তৈরী করে পালন শুরু করি। বাচ্চা আনলেও সব বাচ্চা বাঁচাতে পারিনি। সর্বশেষ একজোড়া তিতি ধরে রাখতে সক্ষম হই। ৬ মাস যেতে না যেতেই তিতি পাখিগুলো ডিম দিতে শুরু করে। এরপর ড়িম ফুটিয়ে সেই এক জোড়া তিতি থেকে এখন আমি কয়েকশ’ পাখির মালিক। এখন আমার খামারে বাচ্চাসহ ৮শ তিতি পাখি আছে। তিতি ছাড়াও টার্কি, কোয়েল ও কাদাকনাথ মুরগী পালন করছি। পাখি গুলো প্রতিদিন ২০০-২৫০ টাকা ডিম দেয়। বর্তমানে ১ দিনের বাচ্চা ২৫০ টাকা, ৮ দিনের বাচ্চা ৩০০ টাকা, ১৫ দিন থেকে ১ মাস বয়সী বাচ্চা ৫০০ টাকা, ২ মাস বয়সী বাচ্চা ১ হাজার টাকা, ডিম প্রতি পিচ ১শ টাকা করে বিক্রি করছি।’
কাপ্তাই, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, হাটহাজারী, সীতাকুণ্ড, মিরসরাই, পটিয়া, ফটিকছড়ি উপজেলাসহ রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম শহর, কক্সবাজার, নোয়াখালী, কুমিল্লা জেলা থেকে তিতি ও তিতির বাচ্চা ক্রয় করতে ক্রেতারা আসেন বলে তিনি জানান।
তিনি আরও বলেন, ‘তিতি’ আসলে পাখি নয়, এটি চীনা মুরগী (তিথির)। তাই বনমোরগের মতো তিতি মুরগীও উড়তে পারে। তিতির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব বেশি বিধায় তেমন রোগ বালাই হয় না। ডিম থেকে বাচ্চা হওয়ার ৬ মাসের মধ্যে তিতি ডিম দিতে শুরু করে। ৬ মাসে একটি পুরুষ তিতির ওজন হয় ৫-৬ কেজি এবং স্ত্রী তিতির ওজন থাকে ৩-৪ কেজি হয়। আমাদের দেশের অনুকূল আবহাওয়া ও পরিবেশে তিতি পাখি পালন অন্যান্য দেশের তুলনায় সহজ। তিতির খাবারের জন্য কোনো সমস্যা হয় না। গম, ধান, দানাদার থেকে কলমির শাক, বাঁধাকপি বেশি পছন্দ করে। মাংস উৎপাদনের জন্য দানাদার খাবার দিতে হয়। তখন একটি তিতির ওজন হয় প্রায় ১৬ কেজি। তিতি বছরে ১১০-১২০টি ডিম দেয়। তিতির দাম তুলনামূলক একটু বেশি। চর্বি কম হওয়ায় অন্যান্য পাখির তুলনায় মাংস খুবই সুস্বাদু।’
সোহেল এই তিতি পাখির খামারকে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে তোলার জন্য চীন থেকে একটি ইনকিউবেটর হ্যাচার ও একটি সেটার মেশিন আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ইনকিউবেটরের মাধ্যমে ২৮ দিনেই ডিম ফুটোনো যায়। তবে সরকারী আর্থিক সাপোর্ট পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা বেসরকারি কোনো ব্যাংক ঋণ পেলে আরো বড় পরিসরে খামার গড়ে তুলার পরিকল্পনা রয়েছে তার।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘তিতি আমাদের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নতুন একটি প্রজাতি। তিতি চীনা মুরগি হলেও পাখি শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় এটিই প্রথম ও একমাত্র তিতির খামার। রোগ-বালাই ও উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় এটি পালন করে সহজেই লাভবান হওয়া যায়। এ কারণে খামারিরা এখন এ ব্যবসার প্রতি ঝুঁকছেন। উপজেলা প্রাণীসম্পদ বিভাগ থেকে তিতি পালনে উৎসাহী করাসহ খামারিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।’
আনন্দবাজার/শাহী