ঢাকা | শনিবার
২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চট্টলকন্যা বিপ্লবী নারী প্রীতিলতার ১০৯ তম জন্মদিন আজ

বাংলার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র বীরসেনানী সাহসী নারী বিপ্লবী চট্টলকন্যা প্রীতলতা ওয়াদ্দেদার। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন অন্যতম বাঙালী নারী বিপ্লবী এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের আত্মোৎসগর্কারী প্রথম নারী শহীদ। আজ অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ১০৯তম জন্মদিন।
১৯১১ সালে ৫ মে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট ইউনিয়নের দক্ষিণ সমুরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার এবং মা প্রতিভা দেবী। বাবা ছিলেন চট্টগ্রাম পৌরসভার হেড ক্লার্ক। নগরীর আসকার দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে টিনের ছাউনি দেওয়া মাটির একটা দোতলা বাড়িতে স্থায়ীভাবে থাকতেন ওয়াদ্দেদার পরিবার।
প্রীতিলতা ১৯২৭ সালে চট্টগ্রামের খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। তারপর ঢাকা ইডেন মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে কলকাতার বেথুন কলেজে ইংরেজী সাহিত্য নিয়ে বি.এ. তে ভর্তি হন। এরপর দর্শন শাস্ত্রে গ্র্যাজুয়েশন শেষে ১৯৩২ সালে চট্টগ্রামের নন্দনকাননে অপর্ণাচরণ স্কুলের ইংরেজি শাখায় প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন।
এদিকে ইডেন কলেজের ছাত্রী থাকাকালীন ১৯২৯ সালে প্রীতিলতা দীপালি সংঘের সদস্য হন। তখন মাস্টারদা সূর্যসেন ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক। মূলত তখন থেকে মাস্টারদার নির্দেশে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন তিনি। প্রীতিলতা মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী দলের প্রথম নারী সদস্য ছিলেন। গড়ে তুললেন এক বিপ্লবী চক্র, যোগ দেন অনেক নারী সদস্য। নারী সদস্য নিয়ে অর্থ সংগ্রহ করে প্রীতিলতা চট্টগ্রামে পাঠাতেন। পাশাপাশি মাস্টারদার নির্দেশে কলকাতার গোপন কারখানায় তৈরিকৃত বোমার খোল সংগ্রহ করতেন। ১৯২৯ সালে পূজার ছুটিতে চট্টগ্রামে গিয়ে বোমার খোলগুলো পৌঁছে দেন বিপ্লবীদের হাতে। এরপর প্রীতিলতা প্রকাশ্য বিপ্লবী কাজে যুক্ত হন। কলকাতার বিপ্লবী চক্রের সকল প্রকার প্রশিক্ষণ তিনি দিতেন।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে শুরু হয় ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ’। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সব অহঙ্কার চূর্ণ করে ৪ দিন স্বাধীন ছিল চট্টগ্রাম।
১৯৩২ সালের মে মাসে প্রীতিলতার জন্মস্থান ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে মাস্টারদা তাঁর সহযোদ্ধাদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেন। এই বৈঠক চলার সময় ব্রিটিশ সৈন্যদের সাথে বিপ্লবীদের বন্দুক যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে প্রাণ দেন নির্মল সেন ও অপূর্ব সেন। সূর্যসেন প্রীতিলতাকে নিয়ে বাড়ির পাশে ডোবার পানিতে ও গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকেন। সাবিত্রী দেবীর বাড়িটি পুলিশ পুড়িয়ে দেয়।
ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজদের বিনোদনের ক্লাব হিসেবে ব্যবহার করা পাহাড়তলির  ইউরোপিয়ান ক্লাবে লেখা থাকতো ‘কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’।
১৯৩২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ কাট্টলী গ্রামে এক গোপন বৈঠকে মাস্টারদার নির্দেশে প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্ত এই ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা করার জন্য একটি গ্রামের উদ্দেশ্যে পুরুষের বেশে রওনা দেন। কিন্তু পথে পাহাড়তলীতে কল্পনা দত্ত ধরা পড়েন।
১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে প্রীতিলতার নেতৃত্বে ১৫ জন বিপ্লবীর একটি দল ইউরোপিয়ান ক্লাবে আক্রমণ চালায়। প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণের নির্দেশ দেন। গুলি আর বোমার আঘাতে পুরো ক্লাব কেঁপে উঠেছিল সেদিন। ইংরেজ কর্মকর্তারা রিভলবার দিয়ে পাল্টা গুলি চালায়।
ওই হামলায় ১ ইংরেজ নিহত এবং ১১ জন আহত হন।আক্রমণ শেষে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হন প্রীতিলতা। পরে গ্রেপ্তার এড়াতে সঙ্গে রাখা পটাশিয়াম সায়ানাইড পান করে আত্মাহুতি দেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম এই নারী শহীদ।
প্রীতিলতা মৃত্যুর আগে শেষ চিঠিতে তার মাকে লিখেছিলেন, ‘মাগো, অমন করে কেঁদো না! আমি যে সত্যের জন্য, স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে এসেছি, তুমি কি তাতে আনন্দ পাও না? কী করব মা? দেশ যে পরাধীন! দেশবাসী বিদেশির অত্যাচারে জর্জরিত! দেশমাতৃকা যে শৃঙ্খলভাবে অবনতা, লাঞ্ছিতা, অবমানিতা! তুমি কি সবই নীরবে সহ্য করবে মা? একটি সন্তানকেও কি তুমি মুক্তির জন্য উৎসর্গ করতে পারবে না? তুমি কি কেবলই কাঁদবে?’ আজ শুধু তার মা নয়, কোটি কোটি দেশপ্রেমী মানুষ আজও অশ্রুসজল চোখে পরম শ্রদ্ধায় এই বীরকন্যা সাহসী নারী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে স্মরণ করেন।
আনন্দবাজার/শাহী

সংবাদটি শেয়ার করুন