ঢাকা | শুক্রবার
২৩শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
৯ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দুদকের নিষেধাজ্ঞা সত্বেও চলছে আফতাবের ঠিকাদারি

বিভিন্ন খাতে অনিয়মের অভিযোগে ১৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রকাশিত ওই তালিকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স এএসএল ও এর স্বত্বাধিকারী আফতাব আহমেদের নামও ছিল। দুদকের ওই নির্দেশনা অনুযায়ী আফতাব আহমেদ ও তার প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সরকারি কোনো ঠিকাদারি কাজে আর অংশ নিতে পারার কথা নয়। এমনকি ব্যক্তি হিসেবে অন্য প্রতিষ্ঠানের নামেও তিনি ঠিকাদারি কার্যক্রম পরিচালনার বৈধতা হারান। এর পরও নিজ মালিকানায় অন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পুরোদমে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন সরকারের সাবেক এ জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব।

সম্প্রতি এক গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, ‘দুদক থেকে আমাদের বলা হয়েছিল শুধু এএসএল নয়, এর মালিক পক্ষের সঙ্গেও যেন কোনো লেনদেন করা না হয়। পরে তিনি এইচটিএমএসএল নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঠিকাদারি কাজ করেন। যেহেতু আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি তিনি নিজেও কালো তালিকাভুক্ত, সেহেতু এইচটিএমএসএলের কাজ পাওয়ার কথা নয়। দুদকের নির্দেশনা অনুযায়ী আফতাব আহমেদ অন্য নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করে যদি পৃথক প্রতিষ্ঠান চালু করেন, তাহলে সেই নতুন প্রতিষ্ঠানও কালো তালিকাভুক্ত হবে। এর পরও অদৃশ্য শক্তির বলে আফতাব আহমেদ ঠিকাদারি কার্যক্রম চালিয়ে যান।’

এএসএলের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে অনিয়ম ও সরকারের ৯ কোটি ১৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৫ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ‘অসাধু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কালো তালিকাভুক্তকরণ’ শীর্ষক দুদকের নির্দেশনায় বলা হয়, সরকারি অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণসহ ক্রয় কার্যক্রমে স্বচ্ছতা আনয়ন এবং এ ধরনের দুর্নীতি, প্রতারণা ও চক্রান্তমূলক কার্যক্রম প্রতিরোধকল্পে ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ এর স্বত্বাধিকারীকে কালো তালিকাভুক্ত করা প্রয়োজন।

পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৯৬ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে অংশ নেয়া পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এইচটিএমএসএল একটি। কালো তালিকাভুক্ত ব্যক্তির মালিকানার প্রতিষ্ঠান এইচটিএমএসএল কীভাবে দরপত্রে অংশ নিল সে বিষয়ে তখন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে সমালোচনা সৃষ্টি হয়। এরপর গত বছরের ২৫ জুন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ তদন্ত করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নির্দেশনা দেয়। এ বিষয়ে জানতে প্রকল্প পরিচালক কবির হাসানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।

জানা যায়, আফতাব আহমেদের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে যোগ দেন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) প্রশাসন ক্যাডারে। চাকরিজীবনের শুরু থেকে আত্মীয়স্বজনের নামে সরকারি বিভিন্ন কাজে ঠিকাদারি করতেন। ২০১০ সালে সরকারের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব পদ থেকে অবসর নিয়ে স্বনামে ঠিকাদারি শুরু করেন।

এ সময় তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল এএসএল। এর পর থেকে আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতা, সরকারের মন্ত্রী ও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় দেড় দশক ধরে ঠিকাদারি কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন তিনি। স্বাস্থ্য খাতে ঠিকাদার হিসেবে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করেন আফতাব আহমেদ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়াও তিনি ঠিকাদারি ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন গাজীপুর, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে। ২০১৯ সালে দুদক কর্তৃক কালো তালিকাভুক্তির পর আফতাব আহমেদ হাই-টেক মেশিনারিজ সল্যুশন লিমিটেড (এইচটিএমএসএল) নামে নতুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চালু করেন। অভিযোগ রয়েছে, এ পর্যন্ত সরকারের কয়েকশ কোটি টাকার কাজ করেছেন আফতাব। বেশির ভাগ কাজই তিনি পেয়েছেন অনিয়মতান্ত্রিকভাবে। নিজ নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এএসএল ও এইচটিএমএসএলের মাধ্যমে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অন্তত ৫০০ কোটি টাকার কাজ সরকারের কাছ থেকে বাগিয়ে নিয়েছেন বলে জানা যায়।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (তৎকালীন কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) হৃদরোগীদের জন্য দুটি ক্যাথ ল্যাব সরবরাহ করে এইচটিএমএসএল। ক্যাথ ল্যাব দুটির জন্য সরকারের ব্যয় হয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। এরপর দুটি ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (এমআরআই) মেশিন কেনা হয় ৩৬ কোটি টাকা দিয়ে। এছাড়া ৬ কোটি টাকায় এক্স-রে ও ১ কোটি টাকায় মেমোগ্রাম মেশিন কেনা হয়। তবে এসব মেশিনের কোনোটিই হাসপাতালের রোগীদের সেবায় কাজে আসেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব মেশিন ও ক্যাথ ল্যাব চালানোর জন্য পরিপূর্ণ সেটআপ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এখনো করে দেয়নি। চুক্তি অনুযায়ী এসব মেশিনে কোনো ত্রুটি দেখা দিলে এইচটিএমএসএলের দেখার কথা, কিন্তু তারা সাড়া দেয় না।

যন্ত্রপাতিগুলোর বর্তমান অবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ক্যাথ ল্যাবটি শুরু থেকেই বন্ধ রয়েছে। এমআরআই মেশিনটিও চালু করা যায়নি। তবে ২০২২ সালে সিটি স্ক্যান মেশিন চালু করা সম্ভব হয়। দুই সপ্তাহ ধরে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সিটি স্ক্যান মেশিনটিও বন্ধ রয়েছে। সেটি মেরামতের কাজ করছে ন্যাশনাল ইলেকট্রো-মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ সেন্টার (নিমিউ)। শিগগিরই সেটি মেরামত হবে।’ এর আগে ২০২৪ সালের ১২ জুন এইচটিএমএসএল বরাবর পাঠানো চিঠিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, এমআরআই মেশিন চালু না করার কারণে রোগীরা সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, সঠিক রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে না।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের যন্ত্রপাতি সরবরাহে দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ আফতাব আহমেদ ও হাসপাতালটির তৎকালীন পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এতে আগের দুই অর্থবছরে সোয়া ১৩ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগ রয়েছে, ৩১টি ভারী যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে প্রকৃত দামের চেয়ে বেশি দাম দেখানো হয়েছে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আইন শাখার কর্মকর্তারা জানান, একটি যন্ত্র কেনার ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কমবেশি করে মূল্য ধরতে হয়। ডলারের মূল্য ওঠানামার কারণে এমনটি করা হয়। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃত মূল্য থেকে চার-পাঁচ গুণ পর্যন্ত বেশি মূল্য ধরেছিল। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার পর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার বিভাগের ঠিকাদারির দিকেও ঝোঁকেন আফতাব আহমেদ। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দুদকের চট্টগ্রাম কার্যালয় জানায়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৪৮ কোটি টাকার এলইডি বাতি স্থাপনকাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এইচটিএমএসএলের বিরুদ্ধে অনিয়ম পাওয়া যায়। পরে তদন্ত করে সত্যতাও মেলে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের ১৪ মে চার দফায় চট্টগ্রাম মহানগরীর ৭৫ কিলোমিটার সড়কে এলইডি বাতি স্থাপন প্রকল্পের কাজ দেয়া হয় এইচটিএমএসএলকে। যদিও পরে বিভিন্ন দফায় সংশোধন করে ব্যয় বাড়িয়ে ৪৮ কোটি টাকা করা হয়। মূলত ২০১৯ সালে দরপত্র আহ্বান করে নগর কর্তৃপক্ষ। সে সময় যেসব প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নেয় তাদের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। পরের বছর পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হলে এইচটিএমএসএল এবং আরো ছয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাতে অংশ নেয়। ২০২০ সালের জুনে কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ২০২১ সালের ডিসেম্বরে।

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নগর কর্তৃপক্ষের তৎকালীন প্রকৌশলীকে মোটা অংকের অর্থ দিয়ে কাজ হাতিয়ে নেন আফতাব। যে কারণে প্রথমবার অংশ নেয়া ঠিকাদারকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। প্রথম পর্যায়ে অংশ নেয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন বাদ দেয়া হয়েছিল তার ব্যাখ্যা দুদককে দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে এইচটিএমএসএল বাদে দ্বিতীয় দফায় অংশ নেয়া অন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কোনো নথিপত্র নগর কর্তৃপক্ষ রাখেনি।

কাজটি শেষ হওয়ার পর ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৬০ কোটি টাকার এলইডি বাতি স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। সেই প্রকল্পের দরপত্রেও অংশ নেয় আফতাব আহমেদের প্রতিষ্ঠান এইচটিএমএসএল। তবে নিজ প্রতিষ্ঠানের নামে দরপত্র জমা দেননি তিনি। ভারতের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসপিএলের উপঠিকাদার হিসেবে কাজ করেছেন আফতাব আহমেদ। ভারতীয় ওই প্রতিষ্ঠানও সে দেশের সরকারের কালো তালিকাভুক্ত বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আফতাব আহমেদ অনেকটা গা ঢাকা দিয়েছেন। তিনি এখন নিজে কোনো দপ্তরে আলোচনার জন্য যাচ্ছেন না। তবে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলছেন।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন আফতাব আহমেদ। গতকাল মুঠোফোনে গণমাধ্যমে তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা। সে সময় অন্যান্য ব্যবসায়ীর মতো হয়রানির অংশ হিসেবে দুদক আমাকেও কালো তালিকাভুক্ত করে। পরে আমি আদালতের দ্বারস্থ হই।’

সংবাদটি শেয়ার করুন