ঢাকা | সোমবার
২০শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
৬ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঝিনাইদহে কুমড়ো বড়ি তৈরি করে স্বাবলম্বী নারীরা

ঝিনাইদহে মাসকালাই আর চালকুমড়ার সাথে কালোজিরা ও মসলা মিশিয়ে তৈরি করা মুখরোচক খাবার কুমড়াবড়ি উৎপাদনের কারখানা ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। এসব কারখানায় প্রতিদিন গড়ে তৈরি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ মন বড়ি। বাণিজ্যিকভাবে যা বিক্রি করে, খরচ মিটিয়ে মাসে কয়েক লক্ষ টাকার ওপর আয় করছেন নারী-পুরুষ ও শিক্ষিত বেকার যুবকেরা। জনপ্রিয় খাবারটি তৈরি আর বাজারজাত করে শুধু কারখানা মালিকই লাভবান হচ্ছেন তা নয়, তৈরি হচ্ছে কর্মসংস্থানও। গ্রামের দুস্থ-অসহায় দেড় শতাধিক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে অজপাড়াগাঁয়ে। এসব কারখানার কুমড়াবড়ি মনপ্রতি ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে। আর তা পৌছে যাচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।

জানা যায়, সারা বছরই কমবেশি কুমড়াবড়ি তৈরি হলেও শীত মৌসুমে-এর চাহিদা থাকে বেশি। আগে সাধারণত বাড়িতেই নিজেদের খাবারের চাহিদা অনুযায়ী কুমড়াবড়ি তৈরি করতেন নারীরা। কিন্তু এখন শুধু বাড়িতেই আটকে নেই। গত কয়েক বছর ধরে জেলার শৈলকুপা উপজেলার গাড়গঞ্জ এলাকায় গড়ে উঠেছে একাধিক কারখানা। প্রথমে পুরুষেরা এ কারখানার উদ্যোক্তা হলেও এখন নারীরাও এসেছেন এসব পেশায়। শিক্ষিত বেকার যুবকেরা কারখানা গড়ে তুলে হচ্ছেন স্বাবলম্বী। উপজেলার গাড়াখোলা গ্রামের গৃহবধূ রাশেদা বেগমের স্বামী ৫ বছর আগে মারা যাওয়ায় ৪ মেয়েকে নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। একটি এনজিও থেকে সামান্য কিছু টাকা লোন নিয়ে শুরু করেছিলেন এ ব্যবসা। এখন তার ওখানে ২০ জন নারী মাসিক বেতনে কাজ করছেন। সরেজমিনে উপজেলার ওই কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, তপ্ত রোদে জালের ওপর শুকাতে দেওয়া হয়েছে সাদা রঙের কুমড়াবড়ি। পাশেই ২০ জন নারী মাসকালাই আর চালকুমড়া মিশিয়ে ম্যাশিনে পেস্ট তৈরি করে নেটের ওপর ছোট ছোট করে বড়ি তৈরি করছেন। সবাই খিল খিল করে হাঁসাহাসি করছেন। এগিয়ে যেতেই কথা হলে তারা জানান, প্রতিদিন সকাল ৮টার মধ্যে বাড়ির রান্নাসহ প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে চলে আসেন কুমড়া তৈরি ওই কারখানায়। আগে থেকেই কারখানা মালিক মাসকলাই আর চালকুমড়া মিশিয়ে ম্যাশিনে পেস্ট করে বড় পাত্রে করে নিয়ে আসেন। তারা সেগুলো মাখিয়ে ছোট ছোট করে বড়ি তৈরি করে নেটে শুকাতে দেন। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত কাজ করে তারা আয় করছেন বাড়তি টাকা।

সুলতানা বেগম নামের এক গৃহবধূ বলেন, ‘সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেদের কাজ শেষ করে ৮টার দিকে কারখানায় চলে আসি। শুরুতে বড়ি তৈরি করি। ৪ ঘণ্টা কাজ করে প্রতিমাসে তিন থেকে ৪ হাজার টাকা ইনকাম হয়।’

বিলকিস খাতুন নামের এক শ্রমিক বলেন, ‘বাড়িতে সারাদিন কোনো কাজ ছাড়া থাকতে হয়। তাই এখানে এসে বড়ি দেওয়ার কাজ করি। সময় কেটে যাওয়ার পাশাপাশি প্রতি মাসে বাড়তি আয়ে ভালোই চলছে তাদের সংসার।’

উদ্যোক্তা রাশেদা বেগম বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর মেয়েদের নিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছিলো। স্বামী ও শাশুড়ি পূর্বে এই পেশায় থাকায় সিদ্ধান্ত নিই আমিও কুমড়াবড়ি তৈরি করবো। প্রথমে এনজিও থেকে লোন নিয়ে শুরু হলেও এখন আমার ব্যবসা বেড়েছে। আমার এসব বড়ি ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘মাসকলাই রোদে শুকিয়ে জাঁতায় ভেঙে পরিষ্কার করে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। ১০ কেজি মাসকলাই থেকে আট কেজি ডাল পাওয়া যায়। এর সঙ্গে ৪ থেকে ৫ কেজি ওজনের কুমড়া ও অন্তত ৩০ টাকার মসলা দিতে হয়। এরপর ভোররাত থেকে শিলপাটায় ডাল মিহি করে গুঁড়ো করা হয়। কুমড়াবড়ি তৈরির পর দুই থেকে তিন দিন একটানা রোদে শুকাতে হয়। সূর্যের আলো একটু আলো কম হলে ৩ থেকে ৪ দিন পর্যন্ত সময় লাগে।’ তিনি আরো বলেন, ‘সরকারিভাবে অল্প সুদে ঋণ পেলে কারখানা বৃদ্ধি করতে পারতাম। এতে আরো অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে।’

এদিকে উপজেলার গাড়াগঞ্জ এলাকায় সর্বপ্রথম কুমড়াবড়ি কারখানা গড়ে তোলা শিক্ষিত যুবক ওয়াহিদ হাসানের কারখানায় গেলেই চোখ কপালে উঠে যাবে। ঢাকা কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্স শেষ করা এই যুবকের কুমড়াবড়ি তৈরির কারখানার বয়স প্রায় ৯ বছর। এই কারখানার বড়ি পৌঁছে যাচ্ছে দেশের প্রায় সব বিভাগে। এছাড়া সেখানে কাজ করছেন ৪০ জন নারী-পুরুষ।

শ্রমিক স্বামী হারা আলেয়া খাতুন বলেন, ‘গত প্রায় ৫ বছর এখানে কাজ করছি। বাড়ির পাশে হওয়ায় আসতে ও যেতে কোনো অসুবিধা হয় না। কেউ পান ১৫০ টাকা আবার কেউ পান ৩০০ টাকা।’

কমলা বেগম নামের এক শ্রমিক জানান, ‘দীর্ঘদিন ধরেই আমরা প্রায় ৩০ জন কাজ করি। দৈনিক মজুরিতে কাজ করি। কাজের ওপর নির্ভর করে পারিশ্রমিক ধার্য করা হয়। ভোর থেকে সকাল ১২টা পর্যন্ত। আমাদের সংসারেরও কোনো সমস্যা হয় না। আরও বাড়তি আয় হওয়ায় পরিবার খুশি।’

শ্রমিক মজনু হোসেন ও জসিম বলেন, ‘৭-৮ বছর ধরে এই কারখানায় কাজ করেন। এখানে মহিলারা যে বড়িগুলো তৈরি করে সেগুলোকে রোদে শুকাতে হয়। বড়িগুলো রোদে শুকানেরার পর সেগুলোকে নেট থেকে উঠায়ে প্যকেটিং শেষ করে কার্টুনে ভরা হয়। এভাবে একটানা ৪-৫ মাস ধরে কাজ চলে। শীত মৌসুম চলে গেলে আবার মাঠের কাজ করেন তারা।’

শ্রমিক আতিয়ার রহমান বলেন, ‘মাসিক ভিত্তিতে বেতনে আমরা এখানে কাজ করি। নারীরা বড়ি তৈরি করে আর আমরা তা শুকাতে দিই। শুকানো বড়ি প্যাকেটও করি। এখান থেকে মাসে ১৫ হাজার টাকা বেতন পাই। এতে সংসার ভালোভাবেই চলছে।’

স্থানীয় সম্রাট হোসেন বলেন, ‘বড়ি তৈরি করে রোদে শুকিয়ে প্যাকেট করে ঢাকা, খুলনা, চিটাগং, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। বাণিজ্যিকভাবে কুমড়াবড়ি তৈরি হওয়ায় সবাই এখন এই সুস্বাদু খাবারের স্বাদ নিতে পারছে। শিক্ষিত এই যুবক নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি অনেকেরই করেছেন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা।’

উদ্যোক্তা ও কারখানার মালিক ওয়াহিদ হাসান বলেন, ২০১৫-১৬ শিক্ষা বর্ষে ঢাকা কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করি। পড়াশোনা শেষ করার পর চাকরি না করে এই ব্যবসায় নিজেকে সম্পৃক্ত করি। ছোট থেকেই ভাবনা ছিল নিজে ব্যবসা করব। বেকারত্ব দূর করার লক্ষ্য রেখেই এই যাত্রা। প্রথমে ১৫-২০ কেজি ডালের বড়ি বানানো হতো। বর্তমানে ৪০০ কেজি ডালের বড়ি তৈরি হয়। এই কারখানায় যেসব পরিবারের মহিলাদের বাড়িতে কোনো কাজ নেই, এমন ৪০ জন নারী এখানে নিয়মিত কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এছাড়াও ৪ জন পুরুষ ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা মাসিক বেতনে নিয়মিত কাজ করেন। এই কারখানায় ৪০-৪৫ জন পুরুষ-মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। এছাড়াও এই বড়িগুলো বিক্রির কাজে ১০ থেকে ১৫ জনের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। এই বড়ি তৈরি করে রোদে শুকিয়ে প্যাকেট করে ঢাকা, খুলনা, চিটাগং, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়।

তিনি আরো বলেন, প্রতিদিন ১০ মন বড়ি তৈরিতে খরচ হয় প্রায় ৪৫ হাজার টাকা। যা থেকে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা লাভ হয়। প্রতি কেজি কুমড়া বড়ি বিক্রি হয় ৩০০ টাকা কেজি দরে। সারাদেশ আগামী ৩ মাস চলবে বড়ি তৈরির কাজ। তিনি অনলাইনের মাধ্যমে অর্ডার নেন। সে অনুযায়ী ডেলিভারি করা হয়। স্থানীয় বাজারেও এর চাহিদা ভালো।

তিনি আরও জানান, আগে ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলেই এই ব্যবসা করা সম্ভব ছিল। কিন্তু বর্তমানে সকল পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এই ব্যবসা পরিচালনা করতে গেলে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা প্রয়োজন।

এ বিষয়ে শৈলকুপা উপজেলা কৃষি অফিসার মো. আরিফুজ্জামান বলেন, ‘কুমড়াবড়ি তৈরি কারখানার উদ্যোক্তা শিক্ষিত যুবক ওয়াহিদ হাসান ও তার কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আমরা দেখেছি তার কারখানায় পরিস্কার ও পরিচ্ছন্ন উপায়ে কুমড়াবড়ি তৈরি করা হয়।’ তিনি বলেন, ‘একজন শিক্ষিত কৃষক, তার মতো কৃষক যেন এভাবে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠে আমরা সেটাই চাই। আমরা তাকে কৃষি লোনের ব্যবস্থা করে দিয়েছি এবং এর মাধ্যমে তিনি তার ব্যবসাকে বড় করে তুলেছে।’ তিনি আরো বলেন, তার উদ্যম ভালো, ইচ্ছাশক্তি প্রবল। তার সাফল্য দেখে ওই এলাকার আশেপাশে একাধিক কারখানা গড়ে উঠেছে। নতুনদেরও আমরা সবরকম সহযোগিতা করবো। ভবিষতে আরো এটা বৃদ্ধি পাবে বলে আমি আশা করি।

শৈলকুপা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) স্নিগ্ধা দাস বলেন, ‘অল্প পুঁজিতে লাভ বেশি হওয়ায় কুমড়াবড়ির সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রান্তিক পর্যায়ের গ্রামীণ নারীরা অর্থনীতিতে বেশ অবদান রাখছেন। এ উপজেলাতে বাণিজ্যিকভাবে সুস্বাদু মাষকলাইয়ের কুমড়াবড়ি তৈরি হয়ে থাকে, তা খুব সুস্বাদু। এ কুমড়াবড়ি আমাদের জেলার চাহিদা পূরণ করে অন্যান্য জেলাতেও সেগুলো সরবরাহ করা হচ্ছে। নারীরা যদি এই কর্মপরিকল্পনা আরো বৃহৎ আকারে করতে চায়, তাহলে আমাদের পক্ষ থেকে তাদের সকল প্রকার সহযোগিতা করা হবে।’

সংবাদটি শেয়ার করুন