জাতিসংঘের এক তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে বড় আকারে দমন-পীড়ন অভিযান চালিয়েছে মিয়ানমার। ফলে তাদের অনেকেই বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বেশ কয়েকটি আপাত:দৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন ফেসবুক পেজের মাধ্যমে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়েছে।
জাতিসংঘের তদন্তের বিষয়ে উল্লেখ করে গত বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) বিষয়টি প্রকাশ করেছে মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতী।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুককে ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর যে অভিযোগ রয়েছে তা সত্য হলো।
জাতিসংঘের তদন্তে জানা গেছে, হাজারো রোহিঙ্গাকে নির্যাতন করে বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য করার আগে বড় আকারে ফেসবুকে এই জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়। ২০২১ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ফেসবুকের বিরুদ্ধে ১৫ হাজার কোটি ডলারের মামলা দায়ের করে। রোহিঙ্গারা দাবি করে, ফেসবুক তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযান ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। এই অভিযোগ সূত্রে জাতিসংঘের তদন্তকারী সংস্থা মিয়ানমারের জন্য নিবেদিত স্বাধীন তদন্ত সংস্থা (আইএমএম) বলেছে, তাদের হাতে নিরেট প্রমাণ রয়েছে যে ফেসবুকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর নেপথ্যে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দায়ী।
সামরিক বাহিনী ‘পদ্ধতিগত ও সমন্বিত’ উপায়ে ‘রোহিঙ্গা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যদেরকে নিয়ে ভীতি ও বিদ্বেষ সৃষ্টি’ করেছে বলে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তদন্তকারীরা জানিয়েছেন। ‘তারা এই উদ্দেশ্য অর্জনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি গোপন নেটওয়ার্ক তৈরি করে, যা লাখো মানুষের কাছে তাদের বার্তা পৌঁছাতে সক্ষম বলে জানানো হয়েছে।’
মিয়ানমারের সবচেয়ে গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধ তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহের জন্য ২০১৮ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল আইআইএমএম প্রতিষ্ঠা করে। উক্ত প্রতিবেদনের নতুন বিশ্লেষণে ২০১৭ সালের জুলাই ও ডিসেম্বরের মধ্যে ৪৩টি ফেসবুক পেজের কনটেন্ট বিশ্লেষণ করা হয়। প্রতিবেদনে জানানো হয়, এই পেজগুলোর মধ্য আপাত:দৃষ্টিতে কোন সম্পর্ক নেই। এদের বেশিরভাগের সঙ্গে সামরিক বাহিনীরও কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেকগুলো পেজের বিষয়বস্তু জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সেলেব্রিটি।
এই পেজগুলো ‘একটি সমন্বিত নেটওয়ার্কের অংশ—এটা ফেসবুকে একটি সামরিক নেটওয়ার্ক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে এসব পেজের ১০ হাজার ৪৮৫টি কনটেন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে, যেগুলোকে বিদ্বেষমূলক হিসেবে অভিহিত করা হয়। ২০১৮ সালের আগস্টে ফেসবুক তাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে এসব কনটেন্ট মুছে দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব পেজে রোহিঙ্গাদের নিয়ে অবমাননাকর ও বৈষম্যমূলক বক্তব্য পোস্ট করা হয়। রোহিঙ্গারা সহিংসতা, জঙ্গিবাদ ও ‘ইসলামকরণের’ মাধ্যমে মিয়ানমারের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে—এমন দাবি করা হয় কোনো কোনো পোস্টে। ফরে এসব পেজের মধ্যে তদন্তকারীরা বিভিন্ন উপায়ে যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন।
এছাড়া প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে একাধিক পেজের প্রতিষ্ঠাতার ফেসবুক আইডি একই ছিল। একই মানুষ একাধিক গ্রুপের এডমিন বা এডিটর হিসেবেও কাজ করেছেন। আবার অনেকগুলো পেজ একই আইপি অ্যাড্রেস থেকে পরিচালনা করা হয়, যা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ব্যবহৃত আইপি অ্যাড্রেসের সঙ্গে মিলে যায়। আইআইএমএম বলেছে, ‘এই নেটওয়ার্কের আওতাধীন একাধিক পেজে একই কনটেন্ট প্রকাশ করা হয়। কখনো কখনো কয়েক মিনিটের ব্যবধানে এ ধরনের পোস্ট দেখা যায়।’ তদন্তকারীরা উল্লেখ করেন, যে সময় সামরিক বাহিনী এই বিদ্বেষমূলক প্রচারণা চালাচ্ছিল, সে সময় ‘রোহিঙ্গাদের গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল এবং হাজারো রোহিঙ্গা পুরুষ, নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন ও যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এমন কী তাদের অনেককে হত্যাও করা হয়।’
আইআইএমএম জানায়, যখন রোহিঙ্গারা তাদের বাড়িঘর ছেড়ে (বাংলাদেশে) পালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন সামরিক বাহিনীর এই বিদ্বেষ প্রচারণা চলমান ছিল। প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়, সহিংসতা ঠেকিয়ে নিজের দেশের মানুষকে সুরক্ষিত রাখার উদ্যোগ না নিয়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন এক ধরনের প্রচারণামূলক অভিযান চালিয়েছে, যা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে উসকে দিয়েছে এবং এই অপরাধের জবাবদিহিতা দূর করেছে।