ঢাকা | শুক্রবার
১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভূগর্ভস্থ পানি হুমকিতে পড়ছে জনস্বাস্থ্য

ভূগর্ভস্থ পানি হুমকিতে পড়ছে জনস্বাস্থ্য

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বুকচিরে বয়ে চলা ঐতিহ্যবাহী লবলঙ্গ সাগর,এই সাগর এখন খালের একটি ড্রেনে পরিনত হয়েছে। শিল্পঅঞ্চল শ্রীপুর উপজেলায় গড়ে উঠেছে বিভিন্ন কলকারখানা এরই মধ্যে এক্স সিরামিক নামক একটি কারখানার পেটে এখন ঐতিহ্যবাহী লবলঙ্গ সাগর। খালটিকে ভরাট করে ইতিমধ্যে নালায় পরিনত হয়েছে। বিভিন্ন কারখানার কর্তৃপক্ষরা লবলঙ্গ খালের চারপাশে স্থাপনা নির্মাণ করে চেপে ধরে গিলে খাচ্ছে। খালের গতিপথ পরিবর্তন, ব্রীজ নির্মাণ করে মাটি পানি ও বায়ু দূষিত করে আশপাশের পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করছে এক্স সিরামিক কারখানাসহ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী লবলঙ্গ সাগরের পাশে গড়ে উঠা বিভিন্ন কারখানা। খাল ভরাট ও গতিপথ পরিবর্তনের ফলে যত্রতত্র জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে প্রতিবছর ক্ষতির মুখে পড়েছে স্থানীয় কৃষকদের ফসলি জমি। জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এক্স সিরামিকেরসহ বিভিন্ন কলকারখার কবল থেকে লবলঙ্গ খাল উদ্ধারের তেমন কোন অগ্রগতি চোখে পড়েনি।

সরজমিনে খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায়, গাজীপুর জেলার শ্রীপুরে পৌরসভার ৯নম্বর ওয়ার্ডের বেড়াইদেরচালা গ্রামে ২০০৯ সালে ৭৫ বিঘা জমি নিয়ে গড়ে উঠেছে এক্স সিরামিক নামক একটি কারখানা। কারখানাটি নির্মাণের শুরুতে ঐতিহ্যবাহী লবলঙ্গ খালের গতিপথ বন্ধ করে নালায় পরিনত করে। বর্তমানে লবলঙ্গ খালটিকে ভরাট করে নালায় পরিনত করেছে। সাপের মতো এঁকেবেঁকে কারখানা কর্তৃপক্ষের ইচ্ছে মতো গতিপথ পরিবর্তন করেছে। খালের কয়েকটি পয়েন্টে তৈরি করেছে অস্থায়ী ব্রিজ। কারখানার ভেতর খালের উপর কালভার্ট নির্মাণ করে দুইপাড়কে যুক্ত করে চলছে কারখানার বিভিন্ন গাড়ি। খালের গতিপথ যত্রতত্র পরিবর্তনের ফলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। কারখানার সকল তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে খালে,কারখানার আগ্রাসনের ফলে অস্তিত্ব বিলিনের পথে। খাল ঘেঁষে নির্মাণ করা হয়েছে স্থাপনা। যত্রতত্র ছেড়ে দেয়া হয়েছে সকল ধরনের তরল বর্জ্য। খালটিকে দুপাশ থেকে আস্তে আস্তে সুকৌশলে ভরাট করছে কারখানা কর্তৃপক্ষ।

বেড়াইদেরচালা গ্রামের কৃষক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, এক্স সিরামিক কারখানা মাঝপথে লবলঙ্গ খালটিকে তাদের ইচ্ছেমতো ব্যবহারের ফলে গত কয়েক বছর যাবৎ আমাদের ফসলের জমিতে যত্রতত্র জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এক্স সিরামিক কারখানার ভেতর খাল ভরাট করে রাখা হয়েছে। তাই সঠিক ভাবে পানি যেতে পারে না। তাই পানি বাধাগ্রস্ত হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে প্রতিবছর ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

শ্রীপুর উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সদস্য ও রসায়নবিদ সাঈদ চৌধুরী বলেন, লবলঙ্গ নদীর দুপাশে যে ফ্যাক্টরীগুলো আছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে অবশ্যই লবলঙ্গ খালের সীমানা ঠিক পূর্বক তাদের উচ্ছেদ করতে হবে। এক্স সিরামিক কারখানা এখানে এসে যেভাবে লবলঙ্গ চেপে ধরা হয়েছে। তাতে নষ্ট হচ্ছে স্থানীয় কৃষকদের শতশত বিঘা ফসলী জমির ফসল। নষ্ট হচ্ছে সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক সম্পদ ভূগর্ভস্থ পানি এবং হুমকিতে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা দখল মুক্ত লবলঙ্গ চাই। প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নেবে এটাই প্রত্যাশা।

বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মো. মনির হোসেন বলেন, ইতিমধ্যে এক্স সিরামিকসহ বিভিন্ন কলকারখানার কর্তৃপক্ষ লবলঙ্গ খালটিকে পেটের ভেতর ঢুকিয়ে নেয়ার শেষ চেষ্টায় মেতে উঠেছে। একটি এলাকার জন্য একটি নদী অথবা খাল সেই জনপদের মানুষের জন্য হৃৎপিণ্ড। লবলঙ্গ খালকে বাঁচাতে পারলে সেই জনপদের মানুষ সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকবে। নদী আইন অনুযায়ী সিএস পর্চা অনুযায়ী নদী বা খালের সীমানা নির্ধারণ হয়। লবলঙ্গ খালের সীমানা চিহৃত করে দ্রুত সময়ের মধ্যে লবলঙ্গ খালটি উদ্ধার করবেন বলে আশাকরি। লবলঙ্গ বাঁচানোর সংরক্ষণ এর বিকল্প নেই।

এক্স সিরামিকস কারখানার মানবসম্পদ কর্মকর্তা শামীম শেখ বলেন, এক্স সিরামিক কারখানা কতৃর্পক্ষ লবলঙ্গ খাল দখল বা দূষণ করছে না। খালের কোন গতিপথ আমরা পরিবর্তন করিনি। সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কতৃর্পক্ষ সীমানা নির্ধারণ করলে বিষয়টি পরিস্কার হবে। আমাদের কারখানা থেকে যত্রতত্র কোন ক্ষতিকারক বর্জ্য পানি খালে সরাসরি ফেলা হচ্ছে না। আমাদের কারখানা ভেতর দিয়ে সব সময় সুন্দর ভাবে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। কারখানার জন্য জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে অভিযোগটি সঠিক নয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ইতিপূর্বে তাহলে কেন কারখানা কতৃর্পক্ষকে অর্থদণ্ড করেছে? এমন প্রশ্নের জবাব তিনি বলেন, প্রশাসন চাইলে কত কি করতে পারে।

গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. নয়ন মিয়া বলেন, লবলঙ্গ খাল দখল দূষণ গতিপথ পরিবর্তনসহ নানান অভিযোগে কারখানার বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ নেয়ার জন্য ইতিমধ্যে উর্ধতন কতৃর্পক্ষকে বিস্তারিত জানানো হয়েছে। জেলা প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে এক্স সিরামিক কারখানার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে। ইতিপূর্বে এই কারখানার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে অর্থদণ্ড আদায় করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, লবলঙ্গ খালকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিবে পরিবেশ অধিদপ্তর। প্রয়োজনে কারখানার সকল ধরনের সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে লবলঙ্গ খালটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে।

গাজীপুর জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, আমি যোগদানের পর থেকে নদী খাল রক্ষার জন্য সকল ধরনের প্রস্তুতি পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে লবলঙ্গ খালের সীমানা নির্ধারণ করে লবলঙ্গ খালটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনবো।

সংবাদটি শেয়ার করুন