রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় শনিবার (০২ ডিসেম্বর) সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, চুয়াডাঙ্গা, নোয়াখালী, কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভূমিকম্পের খবর পাওয়া গেছে।
লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলায় উৎপন্ন এ ভূমিকম্পের রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৬। ঢাকা থেকে ৮৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে রামগঞ্জে ছিল এর উৎপত্তিস্থল। আর এর গভীরতা ছিল ১০ কিলোমিটার। কম্পনের ফলে ইতিমধ্যে বেশকিছু এলাকায় কিছু ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ফলে দেশব্যাপী বিভিন্ন এলাকার সাধারণ মানুষ বিশেষ করে ঢাকা শহরের বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
যদিও এবারের ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি লক্ষণীয় মাত্রায় ঘটেনি, তবুও পূর্ব সতর্কতা ও সঠিক পদক্ষেপ জরুরি বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ. টি. এম. শাখাওয়াত হোসেন।
অধ্যাপক শাখাওয়াতের নেতৃত্বে ভূতাত্ত্বিকভাবে সংবেদনশীল উখিয়া, কক্সবাজার অ লের ভূতাত্ত্বিক কাঠামো গবেষণা করে পার্বত্য অঞ্চল ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ঝুঁকির মাত্রা নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করা হয়। এবছরের আগস্টে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, ‘দেশের উত্তর-পূর্ব অংশ অর্থাৎ সিলেট এবং এর সংলগ্ন অ লটি ভারত, ইউরেশিয়া এবং বার্মিজ প্লেট নামক তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত এবং এই প্লেটগুলির সক্রিয় অভিসারনের ফলে এর উত্তর ও পূর্ব প্রান্ত বরাবর বেশ কয়েকটি বড় সক্রিয় ফল্ট দেখা দিয়েছে। আ লিক স্কেলের এই সক্রিয় স্থানগুলো মাঝারি থেকে বড় আকারের ভূমিকম্প তৈরি করতে সক্ষম।’
এসব এলাকার মাটির গুণাগুন বিশ্লেষণ করে এই গবেষক জানান, এ অঞ্চলের মাটিতে বালির পরিমাণ বেশি এবং কিছু পরিমাণ পলি কাদামাটি (সেন্ড ক্লে) রয়েছে। সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসেবে ৯৩.৬৮- ৯৯.৪৮ শতাংশ বালি, ০.০৬-৪.৭১ শতাংশ নুড়ি এবং ০-৬.২৬ শতাংশ পলি ও কাদামাটি রয়েছে।
বাংলাদেশ হিমালয় সিনট্যাক্সিস দ্বারা বেষ্টিত, যার মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ-পূর্বে ইন্দোবার্মা ফোল্ডেড বেল্ট এবং উত্তর-পূর্ব অংশে ডাউকি ফল্ট, যা অতীতে উচ্চ-মাত্রার (সাত মাত্রার বেশি) ভূমিকম্পের সম্মুখীন হয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দুটি দেশ ভারত ও মায়ানমারও কিছু বড় আকারের ভূমিকম্পের সম্মুখীন হয়েছে এবং বিধ্বংসী পরিণতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিশেষ করে ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল ভূমিকম্প, ১৮৯৭ সালের গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্প এবং ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গলের পর বাংলাদেশের পলিমাটি যুক্ত এলাকায় ভূমিকম্পের ঘটনা রেকর্ড করা হয়।
প্যালিওসিজমিক স্টাডিজ অনুসারে, ‘দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্ব অংশে ডাউকি ফল্ট বরাবর ভূমিকম্পের একটি ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা গেছে। দেশের উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব অ লগুলো ভূমিকম্পের দুটি প্রধান উৎস বিশেষ করে, ডাউকি ফল্ট এবং ইন্দোবার্মা ফোল্ডেড বেল্টের কাছাকাছি থাকার কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। গবেষকরা ভবিষদ্বাণী করে বলছেন, সক্রিয় ডাউকি ফল্ট এবং ইন্দো-বর্মান প্লেটের সীমানা বরাবর চলমান টেকটোনিক প্লেটের বিকৃতির কারণে এসব স্থানে মাঝারি থেকে উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে।
অধ্যাপক শাখাওয়াতের মতে, ‘গতকালের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল দেশের অভ্যন্তরে হওয়ায় আমাদের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ সবচেয়ে বেশি। ভূমিকম্প যদিও পাঁচ মাত্রায় ছিল, যদি এর মাত্রা কোনভাবে ছয় এর কাছাকাছি হতো কিংবা স্থায়িত্ব ২০ সেকেন্ড বেশি হতো তাহলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অনেক বেড়ে যেত।’
ঢাকা শহরের ভূমিকম্পের ঝুঁকি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ঢাকার মাটির গুণাগুণ চট্টগ্রাম বা পার্বত্য অঞ্চল থেকে আলাদা। মধুপুর অঞ্চলের মাটি থাকায় এখানকার মাটিতে কাদামাটির উপর আয়রনের একটা স্তর আছে। আয়রনটা অক্সিডাইজড হলে ফেরোজিনিয়াস সিমেন্টের মতো মাটিকে দ্বিগুণেরও বেশি শক্তভাবে ধরে রাখে। একারণে ঢাকা শহরে ৫/৫.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও কিছু হয়না। এটাকে ‘ঈশ্বর প্রদত্ত’ ঘটনা বলা যেতে পারে।’
ঢাকা শহরে বিল্ডিং কোড যথাযথভাবে অনুসরণ করা জরুরি বলে তিনি বলেন, ‘আমাদের শহরগুলো অপরিকল্পিত ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড একেবারেই অনুসরণ করা হয় না। সয়েল টেস্ট বা আনুষাঙ্গিক টেস্টগুলো না করে; সঠিক ডিজাইন না করে; টাকাপয়সার দিয়ে রাজউকের অফিসারের কাছে থেকে পাশ করিয়ে নেয়া হয়। জিওলজিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাথে অন্যান্য ফিল্ডের ইন্টিগ্রেশনের গ্যাপ থাকার কারণে রাজউক এ সুবিধা নিচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রফেশনালিজম ডেভেলপ করতে হবে। সরকার থেকে আইন করে জিওটেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সয়েল টেস্ট করাতে হবে। ডেভেলপাররা যারা পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।’