ঢাকা | মঙ্গলবার
২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পথশিশুটি অন্ধকার ডিঙিয়ে হতে চায় অফিসার

লক্ষ্মীপুর শহরের অলিগলি যেন ছোট্ট শিশুটির অস্থায়ী আবাস। বাবার খবর সে না জানলেও মায়ের সাথে রাতটুকু পেরোয় তার লক্ষ্মীপুর আলিয়া মাদ্রাসা এলাকায়। নিজ মুখে উচ্চারিত শব্দে আর মনোভবনায় সে ধারণা করে, বাবা কোনো এক অপ্রিয় বস্তুর নাম। এক্ষেত্রে কেবল মা যেন তার সব। মায়াভরা চাহনি দিয়ে মানুষের কাছে হাত পেতে পাওয়া টাকায় চলে তার দৈনন্দিন খরচাপাতি। বছর ছয় বয়সে প্রকৃতির চরম বৈষম্যের শিকার শিশুটির নাম ফরহাদ।

সকাল সাতটার এদিক সেদিক সময়ে বেরিয়ে পড়ে নিজের চিরচেনা লক্ষ্মীপুর উত্তর স্টেশনের উদ্দেশ্যে। সিএনজি চালিত অটোরিকশার জটলা আর অন্য সব যানবাহনের ফাঁকে সে খুঁজতে শুরু করে তাকে দশ-পাঁচ টাকা দিবে এমন সব মানুষদের। গন্তব্যে এসে কেউ পরিবহন ভাড়া পরিশোধের জন্য টাকাকড়ি বের করলেই হাঁসি ফোটে তার মনের কোণে। মায়াভরা চাহনি আর হাসিমাখা মুখটি নিয়ে ভাইয়া অথবা আপু ডেকে শুরু হয় তার হাঁকডাক। প্রথমেই বায়না তার মাত্র দশ টাকার একটি নোট। পরে সেটি নামে পাঁচ টাকায়। বায়না ধরলেও সবসময় মেলেনা টাকা। কেউ জানান পকেট ফাঁকা আবার কেউ দেন তাড়িয়ে। তবে দমে যায় না ছোট্ট ফরহাদ। দিনশেষে হিসেবের খাতা খুলে প্রাপ্ত টাকা গুনলে কোনোদিন সে হয় চরম আনন্দিত। কোনোদিন ভাঙে কোমল মন। যেদিন দেড়শ-দুশো টাকা জমা হয় তার ছোট্ট দুই হাতে সেদিন তার মনে লাগে খুশি। কম টাকা হলে নাকি মন খারাপও হয় তার- এমনটি ভাষ্য ছোট্ট ফরহাদের।

উত্তর স্টেশনে তার বন্ধু-বান্ধবি রয়েছে প্রায় পাঁচ জন। তারাও হাত পাতে মানুষের কাছে। ঐ পাঁচজনের মধ্য ফরহাদের সবচেয়ে প্রিয় মুখটি নিয়ে বেশ কৌতূহল লক্ষ্য করা গেছে। টাকা তোলার সময় তাদের কথা হয় ইশারা ইঙ্গিতে। চোখের মনি ডানবামে ঘুরিয়ে তারা একে-অপরকে বোঝায় কার কাছে ধরতে হবে বায়না। সকাল গড়িয়ে দুপুর নামে। তপ্ত দুপুর, বৃষ্টির পানি, শীতের কুয়াশা কোনোকিছুই বাঁধ সাধে না ছোট্ট ফরহাদ বাবুদের কাজে। জেলা শহরের উত্তর স্টেশনে একমাত্র অধিক অসুস্থতা ছাড়া কোনোদিন অনুপস্থিত হয়না তারা। তাদের প্রহরের পর প্রহর কাটে ব্যস্ততম উত্তর স্টেশনে।দীর্ঘ সময় অবস্থান করার ফরহাদসহ এসব শিশুদের পথশিশু বলা চলে। জেলা শহরের অলিগলিতে প্রতিদিন ফরহাদের মতো বহু শিশুর দেখা মেলে। যাদের অধিকাংশেরই বাবা নেই। মা’ই তাদের একমাত্র অভিভাবক।ছোট্ট ফরহাদের মা তাকে পড়াতে চায়, ফরহাদও চায় পড়তে। কিন্তু বাধ সধে তাদের পেট। একটু ভালো থাকার আশায় শহরের অলিগলি ঘুরে ঘুরে মানুষের কাছে হাতপাতা ফরহাদ বড় অফিসার হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও তার সেই স্বপ্নের পুরোটাই যেন পাপ। কেন তার এমন নিয়তি- এতো কম বয়সে সেটি না জানারই কথা তার। অবশ্য ফরহাদের অফিসার হওয়ার স্বপ্নের পেছনে রয়েছে উত্তর স্টেশনের পাশ ঘেঁষে ঠাঁই দাড়িয়ে থাকা পুলিশ বক্সটি। পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সার্জন ও কর্মকর্তাদের সুসজ্জিত পোশাক বরাবরই মুগ্ধ করে তাকে। বিশেষ প্রযুক্তির মটর সাইকেলের লাল বাতির দিকে তাকিয়ে থাকে সে। এই লালবাতি আর পোশাকের লোভেই অফিসার হওয়ার স্বপ্ন দেখে ফরহাদ। তবে নজরুলের সেই “পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি” কবিতার লাইনের মতো ফরহাদের স্বপ্নও যে ঝলসানো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

শুধু ফরহাদ নয়। জেলার রায়পুর, রামগতি,কমলনগর, রামগঞ্জ ও জেলা সদরে দেখা মেলে এমন অনেক শিশুর। যাদের অনেকেরই নেই নিদিষ্ট কোনো অভিভাবক। তবে সরকারি শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র অথবা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো হয়তো হতে পারতো তাদের আশ্রয়স্থল। কিন্তু কে রাখে কার খোঁজ! দরিদ্রপল্লির পীড়িত এসব শিশুর ভবিষ্যৎ যেন কয়েদ রয়েছে সড়কের আশপাশে-এমন ভাবনা জাগে বহু স্ব হৃদয়বান মানুষের মনে।

তপ্ত দুপুরের পর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামে ফরহাদের চেনা শহরের অচেনা পরিবেশে। দু’হাতের মুঠোয় যে ক’টাকা জমা হয় সেগুলো নিয়ে নীড়ে ফেরে সে। বাড়তি টাকা জমা রাখে মায়ের কাছে। রাত কাটে তার অফিসার হওয়ার স্বপ্নে।

সংবাদটি শেয়ার করুন