ঢাকা | সোমবার
২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রূপালি গিটার ফেলে জাদুকরের চলে যাওয়ার দিন আজ

রূপালি গিটার ফেলে জাদুকরের চলে যাওয়ার দিন আজ

১৮ অক্টোবর, ২০১৮। শহর তখনও পুরোপুরি জাগেনি। গভীর রাতের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ, তারা আয়েশ যখন সকালের ঘুমটা পুষিয়ে নিচ্ছেন ঠিক তখনই অনন্তলোকে পাড়ি জমিয়েছেন তাদেরই প্রিয় সংগীত তারকা।

রক লিজেন্ড আইয়ুব বাচ্চুর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। মাত্র ৫৬ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন জীবনের ওপারে। যে দিন দেশের সংগীতাঙ্গনের উজ্জ্বলতম তারকাটি নিভে গেছে। প্রচণ্ড ভালোবাসা আর অভিমান বুকে নিয়ে রূপালি গিটার ফেলে হেঁটে গেছেন বিরান পথের দিকে, যেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না। একাধারে তিনি ছিলেন গায়ক, লিড গিটারিস্ট, গীতিকার ও সুরকার।

পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে আইয়ুব বাচ্চুর জন্য দোয়া-মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। রাজধানীর সেলিব্রেশন কমিউনিটি পয়েন্টে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় অনুষ্ঠিত হবে এটি। এর আয়োজন করছে চট্টগ্রাম মিউজিশিয়ানস ক্লাব। এতে সংগীত সমাজের মানুষেরা অংশ নেবেন বলে জানা গেছে। অন্যদিকে তার পরিবারের পক্ষ থেকেও থাকছে কিছু আয়োজন। আইয়ুব বাচ্চুর স্ত্রী ফেরদৌস আইয়ুব চন্দনা বললেন, ‘প্রতি বছর যেমনটা করি, এবারও তাই। আসলে এটা ঘোষণা দিয়ে করার কিছু তো না। তার স্মরণে কোরআন খতম আর সাধ্য অনুযায়ী এতিমদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করছি। মগবাজার এবং মিরপুরের একাধিক এতিমখানায় খাওয়ানো হবে।’

গতকাল ১৭ অক্টোবর এশিয়াটিকের সঙ্গে একটি চুক্তি হয় এবি ফাউন্ডেশনের। সেখানে আইয়ুব বাচ্চুর স্ত্রী ফেরদৌস আক্তার চন্দনা ও এশিয়াটিকের পক্ষ থেকে সারা যাকের ও ইরেশ যাকের এবং এলআরবির সদস্য আব্দুল্লাহ মাসুদসহ কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। ফেরদৌস আক্তার চন্দনা বলেন, ‘এবি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আমরা দীর্ঘদিন ধরেই আইয়ুব বাচ্চুর গিটার থেকে শুরু করে নানান স্মৃতি সংরক্ষণে কাজ করে আসছি। এর ভেতরে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তাকে নিয়ে স্মৃতি জাদুঘর, তার স্মরণে কনসার্ট এবং সম্মাননা প্রদানের বিষয়টি। এছাড়া আরও কিছু প্ল্যান নিয়ে আলাপ হয়েছে এই চুক্তি অনুষ্ঠানে। তার তৈরি প্রায় ২০০টি গান একে একে প্রকাশ করা হবে।’ ইরেশ যাকের বলেন, ‘এবি ফাউন্ডেশনের অনেকগুলো পরিকল্পনার সঙ্গে আমরা সহযাত্রী হিসেবে কাজ করব। বাচ্চু ভাই আমাদের প্রাণের মানুষ। আমরা তার গান শুনেই বড় হয়েছি। ব্যক্তিগতভাবে নিবিড় সম্পর্ক ছিল আমাদের। নতুন প্রজন্মের কাছে তার গানগুলো পৌঁছে দেওয়া বা নতুন ভয়েসে আইয়ুব বাচ্চুর গানগুলো আবারও নতুনভাবে উপস্থাপনসহ অনেক কিছু পরিকল্পনায় রয়েছে।’

আইয়ুব বাচ্চু তার প্রথম গান প্রকাশ করেন ‘হারানো বিকেলের গল্প’ শিরোনামে। গানটির কথা লিখেছিলেন শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘রক্তগোলাপ’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। আইয়ুব বাচ্চু ১৯৭৮ সালে যোগ দেন ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডে। এরপর ১৯৮০ সালে ‘সোলস’-এর সঙ্গে শুরু হয় তার পথচলা। প্রায় এক দশক এই ব্যান্ডের সঙ্গেই ছিলেন তিনি।

‘সোলস’ ছাড়ার পর ১৯৯১ সালে গঠন করেন ব্যান্ড ‘এলআরবি’। এলআরবির প্রথম অ্যালবাম প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে।

লিজেন্ড আইয়ুব বাচ্চু সম্পর্কে টুকরো কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক…

জন্ম ও বেড়ে ওঠা: ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামের পটিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন আইয়ুব বাচ্চু। পারিবারিক আবহে সংগীতটা ছিল না। তবে সৃষ্টিকর্তা তার মগজে সুরের ঝংকার প্রোথিত করে দিয়েছিলেন হয়ত। তাই ছোটবেলাতেই গিটারের প্রেমে পড়েন। যদিও বাবার অমত ছিল। কিন্তু ছেলের প্রচণ্ড আগ্রহ দেখে ১১তম জন্মদিনে একটি গিটার কিনে দেন। সেই গিটারেই শুরুটা। দেহ-মননে তিনি যেমন বেড়ে উঠেছেন, তার সঙ্গে বড় হয়েছে সংগীত সত্তাও।

গিটারিস্ট থেকে গিটার গড: বাংলাদেশের প্রথম গিটার তারকা নয়ন মুন্সীর কাছ থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। বিটিভিতে তার গিটার বাজানো দেখেই ছয় তারের এই বাদ্যযন্ত্রে মুগ্ধ হন তিনি। এরপর চর্চা করতে করতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন দেশের শ্রেষ্ঠতম গিটারিস্টে। ‘ফিলিংস’, ‘সোলস’র মতো বিখ্যাত ব্যান্ডে বাজিয়েছেন। আর নিজের ব্যান্ড গঠন করার পর থেকে যেন আরও ঝাঁজালো হয়েছে তার গিটারের সুর। একটা সময় পর থেকে তাকে দেশের ব্যান্ড কমিউনিটি ‘গিটার গড’, ‘গিটারের জাদুকর’ বলেও অভিহিত করেন। গান না গেয়ে শুধু গিটার বাজিয়েও যে কনসার্ট মাতিয়ে রাখা যায়, সেটা প্রথম প্রমাণ করেছিলেন তিনিই।

কলেজ জীবনে ওঠার পরই বন্ধুদের নিয়ে একটি ব্যান্ড গঠন করেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। প্রথমে এর নাম ছিল ‘গোল্ডেন বয়েজ’। পরে নাম বদলে ‘আগলি বয়েজ’ রাখেন। এই ব্যান্ডের গায়ক ছিলেন কুমার বিশ্বজিৎ। আর গিটারিস্ট ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। তারা স্থানীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করতেন। ১৯৭৭ সালে ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডে গিটারিস্ট হিসেবে যোগ দেন এবি। সেখানে ছিলেন জেমসও। তবে আইয়ুব বাচ্চুর উত্থানের সূচনা মূলত ১৯৮০ সালে ‘সোলস’-এ যোগদানের পর। এই ব্যান্ডের হয়ে দশ বছর পারফর্ম করেছিলেন তিনি। অতঃপর ভাবলেন, নিজে কিছু করা যাক। সেই ভাবনা থেকে ১৯৯০ সালে গড়ে তোলেন ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। যা পরবর্তীতে ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’ বা ‘এলআরবি’ নামে বিপুল খ্যাতি লাভ করে।

প্রকাশিত যত অ্যালবাম

ব্যান্ডের হয়ে আইয়ুব বাচ্চু উপহার দিয়েছেন এলআরবি (১৯৯২), সুখ (১৯৯৩), তবুও (১৯৯৪), ঘুমন্ত শহরে (১৯৯৫), ফেরারি মন (১৯৯৬), স্বপ্ন (১৯৯৬), আমাদের বিস্ময় (১৯৯৮), মন চাইলে মন পাবে (২০০০), অচেনা জীবন (২০০৩), মনে আছে নাকি নেই (২০০৫), স্পর্শ (২০০৮) এবং যুদ্ধ (২০১২) অ্যালবামগুলো।

এছাড়া একক শিল্পী হিসেবে তার অ্যালবামের মধ্যে রয়েছে- রক্তগোলাপ (১৯৮৬), ময়না (১৯৮৮), কষ্ট (১৯৯৫), সময় (১৯৯৮), একা (১৯৯৯), প্রেম তুমি কি! (২০০২), দুটি মন (২০০২), কাফেলা (২০০২), প্রেম প্রেমের মতো (২০০৩), পথের গান (২০০৪), ভাটির টানে মাটির গানে (২০০৬), জীবন (২০০৬), সাউন্ড অব সাইলেন্স (ইন্সট্রুমেন্টাল, ২০০৭), রিমঝিম বৃষ্টি (২০০৮), বলিনি কখনো (২০০৯), জীবনের গল্প (২০১৫)। এর বাইরে তার গাওয়া গানের অসংখ্য মিক্সড অ্যালবাম রয়েছে।

কালজয়ী কিছু গান

ব্যান্ড মিউজিক সব মহলে গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন ব্যতিক্রম। তার জনপ্রিয়তা শহর ছাড়িয়ে মফস্বল, গ্রাম, সীমান্ত পেরিয়ে দূরদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছিল। এখানে তিনি শুধু ব্যতিক্রম নন, বিস্ময়ও বটে। তার কণ্ঠে কালজয়ী কিছু গান হলো- ‘সেই তুমি’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘মেয়ে’, ‘কেউ সুখী নয়’, ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’, ‘এক আকাশের তারা’, ‘ঘুমন্ত শহরে’, ‘রুপালি গিটার’, ‘উড়াল দেবো আকাশে’, ‘একচালা টিনের ঘর’, ‘তারাভরা রাতে’, ‘বাংলাদেশ’, ‘বেলা শেষে ফিরে এসে’, ‘আমি তো প্রেমে পড়িনি’, ‘আম্মাজান’, ‘ফেরারি মন’ ইত্যাদি।

চলচ্চিত্রের গান
অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে; আমি তো প্রেমে পড়িনি; আম্মাজান; সাগরিকা বেঁচে আছি।

অপূর্ণ স্বপ্ন

গিটারের পাগল ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। বিশ্বের বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের গিটার ছিল তার সংগ্রহে। কিছু গিটার বিক্রি, কিছু বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে উপহার দেওয়ার পরও অবশিষ্ট ছিল অন্তত ৪০টি গিটার। ইচ্ছে ছিল এসব গিটার নিয়ে একটি সংগ্রহশালা করবেন। পূরণ হয়নি সেই ইচ্ছেটা। তার আরেকটি ইচ্ছে ছিল দেশে মিউজিকের জন্য একটি বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকবে। যেখানে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রসহ গান শেখানো হবে। আর তিনি বসে বসে দেখবেন, সেই প্রতিষ্ঠান থেকে একেকজন শিল্পী হয়ে ক্যারিয়ারে পা রাখছেন। কিন্তু অধরা রয়েছে এই স্বপ্নটাও।

দেশে ব্যান্ড মিউজিক প্রতিষ্ঠার জন্য আমৃত্যু লড়াই করেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। তার মতো করে পরবর্তী প্রজন্মকে কেউ পথ দেখায়নি, উৎসাহ দেয়নি। তিনি চেয়েছিলেন জাতীয়ভাবে ব্যান্ড মিউজিক স্বীকৃতি পাক। বছরের একটি দিনকে ‘ব্যান্ড মিউজিক ডে’ ঘোষণা করা হোক। এই লক্ষ্যে ‘ব্যান্ড ফেস্ট’ নামে একটি আয়োজনও করেছিলেন, যেটা পরপর কয়েক বছর অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তবে তিনি চলে যাওয়ার পর তার কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নটা বাস্তবের পথ দেখেছে। গত বছরের অক্টোবরে চ্যানেল আই ও বাংলাদেশ ব্যান্ড মিউজিক অ্যাসোসিয়েশন (বামবা) যৌথভাবে ১ ডিসেম্বরকে ‘ব্যান্ড মিউজিক ডে’ ঘোষণা করে।

সংবাদটি শেয়ার করুন