দেশের শতবর্ষের ঐতিহ্য পাটকে বলা হয় “সোনালি আঁশ”। তীব্র খরা ও শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে বর্তমানে উৎপাদিত পাট বাজারে বিক্রি করতে গিয়ে হাটে সিন্ডিকেটের কবলে ন্যায্য দাম না পাওয়ায় হতাশ পাট চাষীরা।
সিন্ডিকেট করে পাটের দাম কমানোর অভিযোগ উঠেছে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। চাষিদের পাটের ন্যায্য দাম দিতে প্রশাসনের নিয়মিত বাজার মনিটরিং প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বুধবার (৩০ আগস্ট) রাজশাহীর দুর্গাপুর হাটে পাট বিক্রি করতে এসে দুর্গাপুর উপজেলার সাহিবাড়ি গ্রামের কৃষক আলম হোসেন বলেন, এখন পাট বেচতে হবে তাই বিক্রি করছি। এটা তো আর খাওয়ার জিনিস না যে মানুষ ঘরে থুয়ে (রেখে) এক বছর, দেড় বছরে ধরি খাবে। কৃষক পাট চাষ করিছে। এই পাট কাটতে হয়। জমি থেকে সরাতে হবে। আঁশ ছাড়িয়ে বেচতে হবে। বিক্রি না করলে জমিতে আরেকটা আবাদের টাকা কোথায় পাবে কৃষক। তিনি দেড় বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছেন। এর মধ্যে ১ বিঘা জমির পাট বিক্রি করেছেন ২০০০-২২৫০ টাকা মণ দরে। তার দাবি- তিনি কাঙিক্ষত দাম পাননি। তিনি জানান গত বছরের চেয়ে এ বছর একই সময়ে প্রতি মণে ১০০০-১২০০ টাকা কম দাম পাচ্ছেন কৃষকরা।
দুর্গাপুর উপজেলায় বেশির ভাগ উপজেলায় বর্তমানে পাট কাটা, জাগ দেওয়া, আঁশ ছোড়ানো এবং শুকানো নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। তবে, সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাটের কাঙিক্ষত দাম পাচ্ছেন না চাষিরা। ফলে এক ধরনের হতাশা কাজ করছে চাষিদের মধ্যে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবারের পাটের গুণগত মান ভালো না। আর বিদেশে চাহিদা কম। তাই পাটের বাজার ভালো না।
রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার দুর্গাপুর হাটে বুধবার সকালে পাট বিক্রি হয়েছে প্রতি মণ ১৯০০-২২৫০ টাকা দরে। একই মানের পাট গত বছর বিক্রি হয়েছে ৩০০০-৩২০০ টাকা দরে। সেই হিসেবে পাট চাষিরা প্রতি মণে ১ হাজার টাকা কম পাচ্ছেন। আশ-পাশের হাটগুলোতে একই দামে পাট বিক্রি হচ্ছে। প্রতিদিনই রাজশাহীর কোনো না কোনো উপজেলায় পাটের হাট বসে। উপজেলা পর্যায়ের এসব হাটে কৃষকরা সরাসরি পাট বিক্রি করতে পারেন। এসব পাট কৃষকদের থেকে মৌসুমী ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা কিনে থাকেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পাট কিনে সরাসরি পাটকল মালিকদের কাছে বিক্রি করেন। আর কোনো কোনো আড়তদার পাটগুলো গুদামজাত করে রাখেন। এরপর ব্যবসায়ীদের কাছে সময় মতো তারা পাটগুলো বিক্রি করে থাকেন। পাটের হাট বসে ভোর ৫টা থেকে। চলে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ৮টা পর্যন্ত। কৃষকরা তাদের পাট বিক্রি করতে আসেন হাটগুলোতে। জেলার পুঠিয়ার তাহেরপুরে পাটের হাট বসে সপ্তাহের শুক্রবার। সপ্তাহের শনিবার ও মঙ্গলবার পুঠিয়ার বানেশ্বর হাটে পাট কেনাবেচা হয়। আর রোববার ও বুধবার দুর্গাপুর উপজেলায় পাটের হাট বসে। বৃহস্পতিবার পবা উপজেলার নওহাটা ও পুঠিয়ার ঝলমলিয়ায় হাট বসে। যদিও এই দিনগুলো সাপ্তাহিক হাট বার।
কৃষক হেলাল হোসেন বলেন, পাট চাষে যে পরিশ্রম করি সেই টাকা পাই না। গত বছরের চেয়ে এ বছর পাটের দাম প্রতি মণে ১ হাজার টাকা কম। পানি সংটের কারণে এ বছর পাট জাগ দেওয়াকে কেন্দ্র করে কৃষকের অতিরিক্ত খরচ হয়েছে। এলাকা ভেদে এক বিঘা জমির পাট কেটে পানিতে জাগ দিতে একেকজন কৃষকের খরচ হয়েছে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা। শুধু তাই নয়, পাট শুকানো, বাট বাঁধাই করা, গাড়িতে করে হাটে নিয়ে আসা পর্যন্ত কৃষকের খরচ হয়। তিনি বলেন, পাট বিক্রি করে কৃষকের প্রতি মণে ১ হাজার টাকা লোকসান হবে এই বছর। কারণ লাভের টাকা পাট জাগ দেওয়া বাবাদ শেষ হয়েছে। এ বছর কোনো কৃষক নিজের ইচ্ছো মতো সহজ জায়গায় পাট জাগ দিতে পারেনি। কারণ পানির অভাব। অনেকেই আবার পাট জাগ দিতে পুকুরও ভাড়া নিয়েছে। এক মণ পাট তৈরি করতে প্রায় ২ হাজার টাকা খরচই পড়েছে। কিন্তু হাটে এসে কৃষককে সেই পাট বিক্রি করতে হচ্ছে ২ হাজার টাকা মণ দরে।
বুধবারের হাটে সর্বোচ্চ ভালোমানের পাট ২২০০ টাকা মণ দরে কেনাবেচা হয়েছে। এরপরের মানের পাট বিক্রি হয়েছে ১৯০০-২০০০ টাকায়। পাটকল মালিকরা ২১০০-২২৫০ টাকা দরে পাট কিনছেন। এর বেশি দামে তারা পাট কিনছেন না। পাট কল মালিকদের কাছে বেশি দাম চাইলে তারা পাট ভর্তি গাড়ি ফিরিয়ে দিচ্ছেন। ৫০ কেজির এক বোঝা পাট বাঁধা, যানবাহনে পাট কল পর্যন্ত পৌঁছাতে একজন ব্যবসায়ীর খরচ হয় ১২০ টাকা। পাটকলের মালিকরা দাম কমিয়েছেন।
পাট ব্যবসায়ী মেহের আলী ফরিদপুরের দামষ এলাকার একটি পাট কল মালিকের কাছে ৮০ লাখ টাকা পাবেন। তার দাবি- শুধু তারই নয়। অনেক পাট ব্যবসায়ীর এমন বকেয়া রয়েছে পাটকল ব্যবসায়ীদের কাছে। একেকজনের তিন থেকে চার কোটি টাকাও বকেয়া পড়ে আছে। এ বছর পাটের দাম কম। তাই তারা ভালো পাট অল্প দামে পেয়ে যাচ্ছেন। কয়েকদিন পর পাটকল মালিকরা কম মানের পাট নেবেন না। কারণ তারা বাইরে সেল করতে পারবেন না। বিদেশে পাট রপ্তানি চালু থাকলে পাটের দাম গত বছরের মতো ভালো পেতেন কৃষকরা।
চাষিদের অভিযোগ, গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে জেলার স্থানীয় পাটের হাটগুলোতে মানভেদে প্রতি মণ পাটের দাম ৪০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা কমানো হয়েছে। হাটগুলোতে বাজার মনিটরিং-এ প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দফায় দফায় পাটের দাম কমাচ্ছেন। এতে অনেক চাষিরা উৎপাদিত পাট হাটে এনেও দাম কম থাকায় বাড়িতে ফেরত নিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। যারা বিক্রি করছেন তাদের হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।