কালের বিবর্তনে প্রত্যন্ত জনপদে রাস্তাÑঘাট তৈরী হওয়ায় কোষা, বজরা, গয়না নৌকার সঙ্গে বড় বড় পণ্যবাহী নৌকার বিলুপ্ত ঘটলেও ত্রিনদবিধৌত সিরাজগঞ্জ শাহজাদপুর উপজেলায় কৈজুরীতে ডিঙি নৌকার হাট এখনও টিকে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। বর্ষার আগমনকে ঘিরে জমে উঠতে শুরু করেছে ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী নৌকার হাটটি। কৈজুরীতে সপ্তাহের সোমবার ও শুক্রবার হাট বসলেও নৌকার হাট বসে শুক্রবার।
নি¤œাঞ্চল হিসেবে পরিচিত শাহজাদপুরের সিংহভাগ এলাকা বর্ষার শুরুতেই প্লাবিত হওয়ায় গ্রামীণ জনপদের মানুষের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হয় ডিঙি নৌকা। নদীপাড়ের লাখো মানুষকে পুরো বর্ষা মৌসুম এমনকি বর্ষার পরেও অনেক দিন ডিঙি নৌকায় চড়েই চলাফেরা করতে হয়। তাই বর্ষার আগমনকে ঘিরেই কেনাÑবেচা জমে উঠতে শুরু করেছে কৈজুরী ডিঙি নৌকা হাটে। যমুনা, করতোয়া, বড়াল, হুড়াসাগর আর গোহালা নদীর মতো বড় বড় নদী শাহজাদপুর উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহমান থাকায় শত বছর আগে থেকেই যমুনা পাড়ের কৈজুরীতে নৌকার হাট বসে আসছে।
প্রতি শুক্রবারে শাহজাদপুর উপজেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার পূর্ব দিকে যমুনা নদীর তীরে কৈজুরীতে নৌকার পসরা সাজিয়ে হাট বসছে এখনও। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এ ডিঙি নৌকার হাটে সড়ক ও নদীপথে বিক্রির জন্য শতাধিক ডিঙি নৌকা আনা হয়েছে। শাহজাদপুর উপজেলা ছাড়াও বেলকুচি, চৌহালী এমনকি পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার ও বহু মহাজন ডিঙি নৌকা বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন এই হাটে। দুর দুরান্ত থেকে ক্রেতারাও ছুটে আসছেন এই হাটে। বিভিন্ন ধরনের নৌকা তৈরি করা তারা জামরুল, কড়ই, আম, কদম ও শিমুল গাছের কাঠ দিয়ে তৈরী করা হয়েছে ডিঙ্গি ও কোষা নৌকা। নয় ফুট থেকে শুরু করে ১৫ পর্যন্ত লম্বা ডিঙি নৌকা বিক্রি হচ্ছে এ হাটে। ফলে কাঠ ও আকার ভেদে নৌকার দামও সর্ব নি¤œ ৪ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকার ডিঙি নৌকা পাওয়া যায়।
বেশ কয়েকজন নৌকার কারিগর জানান, বর্ষা এলেই এ অঞ্চলে নৌকার চাহিদা বেড়ে যায়। সারা বছর অন্য কাজ করলেও এসময় তারা শুধু নৌকাই তৈরি করেন। বছরের তিন থেকে চার মাস তাদের এ ব্যস্ততা থাকে। এখন দিন-রাত নৌকা তৈরিতেই সময় কাটছে তাদের।
কৈজুরী হাটে নৌকা কিনতে আসা আজমত আলী বলেন, ‘এই হাট খুব পুরোনো। আমরা ছোট বেলায় দাদার সঙ্গে এখানে নৌকা কিনতে এসেছি। তখন উৎসাহ আনন্দটা ছিল একেবারে ভিন্ন। তখন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা দিয়ে বড় নৌকা কিনে বইঠা দিয়ে বেয়ে বাড়ি গিয়েছি। এখন সে আমেজ আর নেই।’ নৌকা নিয়ে যেতে হয় ভ্যান গাড়ীতে করে।
রতনকান্দী গ্রামের নৌকা ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক মেম্বর জানান, নৌকা তৈরি ও বিক্রি পেশার সঙ্গে জড়িত ২০ বছর ধরে। এখন যারা নৌকা কিনছে তারা শুধু নদী ও বন্যায় পারাপারের জন্য। প্রতি বছর ৫০ থেকে ১০০টি নৌকা তার কারখানায় তৈরী হয়। এখন পর্যন্ত কেনা-বেচা আশাব্যঞ্জক নয়। তবে বন্যার পানি বাড়লেই নৌকার চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। জমে উঠবে কেনাবেচা।
কৈজুরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোয়াজ্জেম হোসেন খোকন বলেন, কৈজুরী ডিঙি নৌকার হাট প্রাচীণকাল থেকেই বসে আসছে। দুর দুরান্ত থেকে মানুষ নৌকা কিনতে আসতো। তবে আগের মতো জৌলুস নেই এই হাটে। গ্রাম গঞ্জে যত্রতত্র রাস্তাÑঘাট হওয়ায় ডিঙি নৌকার কদর কমে গেছে। তবুও কৈজুরী নৌকার হাট শত বছরের ঐতিহ্যবহন করছে।