স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক সম্মুখ সারির যোদ্ধা স্বাধীনতার পরবর্তী রাজনৈতিক মেরুকরণের দোলাচলে পড়ে এখন অবধি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি। তাদেরই একজন গুলু মরমু। পত্নীতলা উপজেলার নিরমইল ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামের বাসিন্দা। মুক্তিযোদ্ধ দেখেছেন একেবারে কাছ থেকে। শুধু যুদ্ধে কেন মৃত্যু পর্যন্ত দেখতে হয়েছে নিকট থেকে। প্রায় ৫০ জন মানুষের সাথে তাকেও ব্রাশ ফায়ার করা হয়েছিল।
প্রথমে গুলি না লাগলেও পরবর্তীতে দেশীয় রাজাকারদের দ্বারা তিনটি গুলি তার দিকে নিক্ষেপ করা হলে তার একটি পা ভেদ করে বের হয়ে যায়। প্রাণে বেঁচে যান তিনি। কিন্তু সৈয়দপুর, নিরমইল, হালিমনগর, আলপাকা, হলাকান্দর, পাইকবান্দা, উত্তরামপুর গ্রামের ৫০ জন মানুষকে জীবন দিতে হয়েছিল।
১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর সকালে ১৩ বছরের গুলু মরমু গরু চরাচ্ছিল। একজন রাজাকার তাকে ধরে নিয়ে পাইকবান্দা ফরেস্ট অফিসের সামনে নিয়ে আসেন। সেখানে শত শত মানুষকে একত্রিত করা হয়েছিল। পাক হানাদারেরা রাজাকারের সহযোগিতা নিয়ে কারা মুসলমান এবং কারা মালাঊন (আদিবাসি বা হিন্দু) তা চিহ্নিত করে নিয়ে যান হালিমনগরে। সেখানে তাদের দিয়ে কাঠের ব্রিজ নির্মাণ করা হবে বলে ডেকে আনা হয়। সাথে কূয়া হতে পানি তোলার কাজে ব্যবহৃত রশিটিও নিয়ে আসা হয়।
খালের পশ্চিমপাশে সবাইকে হাত পেছনে বেঁধে ব্রাশ ফায়ার করা হয়। গুলু মরমুকে তাদের সাথে থাকা গামছা দিয়ে হাত বাঁধা হয়েছিল। পাকবাহিনি আর তাদের দোসররা চলে যাবার পর জ্ঞান ফিরে এলে হাতের বাঁধন খুলে ধীরে ধীরে সৈয়দপুরের দিকে রওনা হয়। কিন্তু বিধ্বস্ত পা তিনি হাঁটতে পারছিলেন না। ক্ষতস্থানে গামছা বেঁধে শালবনে লুকিয়ে থেকে তিনি শুনছেন মৃতপ্রায় অনেক মানুষের গগন বিদায়ী আহাজারি।
পানি পানি করে চিৎকার করে ক্রমে ঢলে পড়া মানুষের মৃত্যুর মিছিল বাড়তে থাকলে পুনরায় ফিরে এসে পাক হানাদাররা হালিমনগরকে কলংকিত করে ফেলে। দ্বিতীয়বার এসে গুলি করে জীবিত প্রতিটি মানুষকে মেরে চলে যায়। হানাদারদের সেদিনের সেই নির্মমতা দেখে এখনো ভয়ে আঁতকে উঠেন তিনি। রাতের আঁধারে হামিগুড়ি দিয়ে প্রায় ৩ কিলোমিটার একলা পাড়ি দিয়ে নিজ গ্রাম সৈয়দপুরে পৌঁছান তিনি। দিনের বেলায় রাজাকার এবং পাক হানাদারদের তান্ডবে ইতোপূর্বে গ্রামরে সবাই বাড়ি ছেড়েছেন। তিনি উপায় না দেখে প্রথমে মোল্লাপাড়া এবং পরে ভারতের বালুরঘাট জেলার তপন থানার আশ্রয় শিবিরে পৌঁছান। সেখানে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ্য হয়ে উঠেন। তবে পায়ের চারটি আঙ্গুল চিরতরে হারাতে হয়েছে। ইতোমধ্যে ১৬ ডিসেম্বর চুড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলে দেশে ফিরে আসেন তিনি।
১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর হালিমনগর বধ্যভূমিতে স্থায়ী ৩৬ জন আদিবাসি ও হিন্দু শহীদ হলেও এখানে ধান কাটতে আসা নাম না জানা আরো ১৪/১৫ জন শ্রমিক শহীদ হয়েছিল। পরের দিন রাজাকার এবং পাক বাহিনী হলাকান্দ গ্রামের আয়নাল, সাইফুল ও তারেককে ধরে নিয়ে এসে শহীদদের লাশ মাটিতে পুঁতে রাখতে বাধ্য করে। এতোগুলো লাশ একত্রে মাটি চাপা দিয়ে রাখাও এদেশের বধ্যভূমিগুলোর ইতিহাসে বিরল।
তবে বীর শহীদদের সেই স্মৃতি সংরক্ষণে আজ এত বছরেও উদ্যোগ নেই। একাধিকবার নওগাঁ জেলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ বধ্যভূমিটি সংরক্ষণ এবং জাতীয়ভাবে এখানে অনুষ্ঠান আয়োজনের আহ্বান জানালেও প্রশাসনের সুনজরের বাইরের থেকে গেছে বধ্যভূমিটি। একসময়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বধ্যভূমি সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের ঘোষণা দিলেও তা আজও আলোর মুখ দেখেনি।
হালিমনগর বধ্যভূমি সংরক্ষণ পরিষদের নেতা হাকিম ওরাঁও এর সাথে কথা হলে তিনিও প্রশাসনের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। কথা হয়েছিল বধ্যভূমিতে ব্রাশ ফায়ার থেকে বেঁচে ফেরা গুলু মরমুর সাথে। তিনি হতাশ ও আবেগে আপ্লুত হয়ে শুধু চোখের কয়েক ফোঁটা পানি ফেললেন। তিনি কাউকে দোষ না দিয়ে, বরং নিয়তিকে দোষারোপ করলেন। নিরমইল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও শিহাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা বলেন, এই বধ্যভূমিটি আমাদের স্মৃতি। এটি সংরক্ষণের জন্য আমরা সার্বিক সহযোগিতা করবো।