- বিচারের বাণী এখন প্রকাশ্যেই কাঁদে!
দেশে-বিদেশে আলোচিত এবং সমালোচিত এতবড় নৃশংস ঘটনার মামলাটি ১৯ বছর পেরিয়ে গেলেও বাদীপক্ষ কোনো বিচার পাননি। মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে নিঃস্ব হয়ে গেছেন মামলার বাদী ডা. বিমল শীল। এভাবে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা বিচারের কাজকে প্রভাবিত করে এবং খুনিরা আরও নৃশংস ঘটনা ঘটাতে উৎসাহিত হয়।
২০০৩ সালের ১৮ নভেম্বর দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর ইউনিয়নের শীলপাড়ায় রাতের অন্ধকারে ডাকাতরূপী একদল নরপশু এবং সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে ন্যাক্কারজনক ও নৃশংসভাবে পুড়িয়ে মারে ১১ জন সংখ্যালঘু হিন্দুকে। নিহতরা হলেন তেজেন্দ্র শীল (৭০), বকুল বালা শীল (৬০), অনিল কান্তি শীল (৪২), স্মৃতি রানী শীল (৩০), সোনিয়া শীল (৭), রমণী শীল (১১), বাবুটি শীল (২৫), প্রসাদী শীল (১৭), এ্যানী শীল (১৫), দেবেন্দ্র শীল (৭০) এবং ৪ দিনের শিশু কার্তিক শীল।
এমন বর্বর হত্যাকাণ্ডটি ঘটানোর পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ভারতের তৎকালীন হাইকমিশনার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিন্দা জানিয়ে ওই মামলায় সহযোগিতার আশ্বাস দিলেও পরবর্তীতে কেউ খোঁজ-খবর নেন নি বলে জানিয়েছিলেন বাদী ডা. বিমল শীল ২০১৭ সালের ১১ জনের ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে। এ খবর জানার পর থেকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি।
বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময় চার্জশিট পরিবর্তন করে সর্বশেষ ২০১১ সালের ৯ জানুয়ারি ৩৯ জনকে আসামি এবং ৫৭ জনকে সাক্ষী করে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সিআইডি’র এএসপি হাচিং প্রু আদালতে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন। পরে রাজনৈতিক বিবেচনায় এক আসামিকে বাদ দেয়ায় আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৮ জনে। এমন ন্যাক্কারজনক ও নৃশংস ঘটনাটি ঘটানোর পর দীর্ঘ ১৯ বছর হতে চললেও এখনও পর্যন্ত মামলার সুরাহা হয়নি।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, একে একে ৪ বার চার্জশিট পরিবর্তন করা হলেও ওই মামলার প্রধান আসামি বিএনপি নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে কোনো বারই অভিযোগ করা হয়নি। যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয়-স্বজনসহ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পর্যন্ত অন্যায় করে পার পাচ্ছেন না, সেখানে একজন বিএনপি নেতার ভাই হওয়ার কারণে একটা ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বাদীর বার বার আবেদনের পরেও অভিযোগ গঠন করা হয়নি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা সাম্প্রদায়িক ঘটনার ইতিহাসে একটি ন্যাক্কারজনক স্বজনপ্রীতির উদাহরণ হয়ে থাকবে। বর্তমানে আসামিরা শার্টের বোতাম খুলে দিয়ে হাওয়া খেয়ে সবার সামনে ঘুরে বেড়ালেও প্রশাসনের দৃষ্টিতে তারা সবাই পলাতক বলে জানা যায়।
মামলাটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়, চট্টগ্রাম তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক এইচএম সফিকুল ইসলামের আদালতে মামলাটির বিচার কাজ চলছে। গত ১৯ বছরে ৫৭ জনের মধ্যে সাক্ষী দিয়েছেন মাত্র ২২ জন। হারাধন শীল নামক একজন সাক্ষী মারা যাওয়ায় আরও ৩৪ জনের সাক্ষী বাকি রয়েছে। তাই বাকি সাক্ষীদের অপেক্ষায় বিচার কাজ বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এ মামলায় আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করা হয়েছে।
মামলার পিপি এডভোকেট ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী জানান, মামলার বাদীর সাথে আমাদের যোগাযোগ আছে। সাক্ষীদের উপস্থিত করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। শত শত পাড়া-প্রতিবেশির সামনে এমন ন্যাক্কারজনক মর্মান্তিক ঘটনাটি সংঘটিত হলেও দীর্ঘ ১৯ বছরেও এ মামলার কোনো কুলকিনারা না হওয়ায় দেশবাসী হতাশ।
সুতরাং এমন নৃশংস ঘটনার নিন্দা জানিয়ে ওই নারকীয় হত্যাকান্ডের সুষ্ঠ বিচারের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ঐক্যবদ্ধতা কামনা করে দ্রুত বিচারের দাবি জানাই। এ বিষয়ে বর্তমান আইনমন্ত্রীর জরুরি সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট।