- অবৈধ পথে রেমিটেন্স আসে ৪৯ শতাংশ
দেশের অর্থনৈতিক রিজার্ভ ঠিক রাখতে হলে বৈধপথে রেমিটেন্সের প্রবাহ বাড়াতে হবে। কেননা রপ্তানি বা আমদানি করে এটি সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে যত ধরনের প্রতিবন্ধকতা আছে তা ছুঁড়ে ফেলে বৈধপথে রেমিটেন্স আনতে পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের এখন যে পরিমাণ রেমিটেন্স আসছে তার বিপরীতে ৪৯ শতাংশ রেমিটেন্স আসে অবৈধপথে। ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম-ইআরএফ ‘বৈধপথে রেমিটেন্স পাঠাতে বাধা ও ডিজিটাল প্লাটফর্মে সম্ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব কথা বলা হয়।
গতকাল বুধবার রাজধানী ঢাকার পুরানা পল্টনস্থ নিজস্ব কার্যালয়ে অনুষ্ঠানে ইআরএফ সভাপতি শারমিন রিনভির সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এমপি। ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশেদুল ইসলামের সঞ্চালনায় মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং-সানেমের চেয়ারম্যান ড. বজলুল হক খন্দকার।
এম এ মান্নান বলেন, রেমিটেন্স সিলেটের জীবনধারাই পরিবর্তন এনেছে। শ্রমিকরা নিজেদের প্রয়োজনে বিদেশ গেছে। তারা না খেয়ে পরিবারের কাছে টাকা পাঠায়। তারা সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতি নাখোশ। এসব গ্যাপ না কমলে তারা সরকারি পদ্ধদিদে আসবে না। আর আমরা এখানে শুক্রবার সবকিছু বন্ধ রাখছি। এতে সপ্তাহে তিনদিন বন্ধ থাকছে। মধ্যপ্রাচ্য ও পাকিস্তানও রবিবারে বন্ধ নিয়েছে আর আমরা এখনো শুক্রবারেই আছি। সরকার ট্রেক ভাঙতে চায়। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।
ড. বজলুল হক খন্দকার বলেন, ২০২২ অর্থবছরে ৫৪ বিলিয়ন ছিল ইক্সপোর্ট। দেশে ৪৯ শতাংশ রেমিটেন্স অবৈধ পথে আসে। এসব যদি বৈধপথে আনা যায় তবে অনেক সমস্যার সমাধান হয়। হুন্ডির বাইরে বৈধপথে টাকা আনতে হলে মোবাইল ফিনান্স সার্ভিস-এমএফএসের মাধ্যমে ৩ শতাংশ খরচ কম লাগে। তাৎক্ষণিক ক্যাশ আউট করলে সুবিধা বেশি হয়। ৫৫ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৪৪তম। ডিজিটাল ইনফ্রাস্টাকচার উন্নত করা। মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে বেশিরভাগ টাকা পাঠানো হতো হুন্ডিতে। এই সমস্যা সমাধানে টাকা পাঠাতে পাকিস্তানে মাইক্রো-ফাইনান্স বেড়ে গিয়েছিল।
উন্নয়ন সমন্বয়ের ফেলো খন্দকার সাখাওয়াত আলী বলেন, অপ্রদর্শিত আয় অর্থনীতির জন্য হুমকি। শ্রমিকরা যে আয় করছে তা বিদেশেই রেখে দেয়া হচ্ছে। এমএফএসের সমস্যাগুলো বিএফইউইকে দেয়ার কারণে তারা বিষয়টি ধরতে পারছেন। সরকারের পক্ষ থেকে ক্রনিক ইকোনোমি তুলে ধরতে হবে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আন্তঃমন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ, পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় মিলে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ইসকান্দার মিয়া বলেন, বিদেশে অবস্থানরত শ্রমিকদের খোঁজখবর নেয়া হয় না। ৬০-৭০ শতাংশ নিজেদের ব্যয় হয়। ৩০ শতাংশ টাকা পাঠানো সম্ভব হয়। কর্মীরা যেখানে আছে তাদের সুখ-দুঃখে যুক্ত থাকতে হবে। কোন এলাকার মানুষ বেশি যাচ্ছে তাদের সন্ধান করা। তাদের বৈধপথে আনার ব্যবস্থা করা হবে। অবৈধপথে আনতে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। রপ্তানির ক্ষেত্রে অর্থ আসছে না। অথচ কর্মীরা যে দেশে আসছে সেখান থেকে টাকা আসছে। তারা কাগজে কলমে রপ্তানি দেখিয়ে টাকা পাচার হচ্ছে। আর ইম্পোর্ট না করে অন্যভাবে টাকা দেখানো হয়। বর্ডার নিয়ন্ত্রণ, মাদক ব্যবসায়ীদের ধরতে হবে। মামলাগুলো স্পেশাল আদালতে নিতে হবে।
পিইবির চেয়ারম্যান ও সিইও মাশরুর রিয়াজ বলেন, চারটি স্থান থেকে ডলার আসে। এফডিআই, ইক্সপোর্ট, ইম্পোর্ট ও বৈদেশিক ঋণ। ইক্সপোর্টে বৈচিত্র আনতে হবে। সার্ভিস ইক্সপোর্ট বাড়াতে হবে। ১৪ শতাংশ সার্ভিস ইক্সপোর্ট অথচ বিশ্বের সেটি ১৮ শতাংশ। দক্ষিণ আফ্রিকায় ১০ বছরে তৃতীয় বাংলাদেশ। নিরাপত্তাহীনতার কারণে ৩২ শতাংশ মানুষ মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে না।
নারীরা পুরুষদের দোকানে যেতে অনেক ক্ষেত্রে আগ্রহী নয়।
বিকাশের শেখ মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, বিকাশে সরাসরি রেমিটেন্স আসে না। এমএফএসের এজেন্টদের ব্যবহার করে হুন্ডি হচ্ছে। যে টাকা পাঠায় ও পায় তা সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যায়। বিকাশের রেমিটেন্স নভেম্বরে প্রতিদিন গড়ে দেড় মিলিয়ন ডলার আসছে। গত বছরের চেয়ে ৬৪ শতাংশ বেশি বৃদ্ধি হয়েছে। ১ কোটি ৩০ লাখ বাইরে কাজ করে তারমধ্যে ৭৫ লাখ মধ্যপ্রাচ্যে। পশ্চিমা দেশ থেকে রেমিটেন্স বেশি আসছে ডিজিটাল মাধ্যমে। বিকাশ ১২টি ব্যাংশ ও ৭০টি দেশ থেকে রেমিটেন্স আনছে।
ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুল মাওলা বলেন, ইসলামী ব্যাংকের কাজ শুরু রেমিটেন্সের মাধ্যমে। ১১ বছরে বিশ্বের যে রেমিটেন্স ২০-৩০ এখানে এসেছে। ১২ বিলিয়ন বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেয়া হয়েছে। রেমিটেন্সে দুটি সমস্যা ১. টাকা পাঠানো ২. টাকা গ্রহণ। প্রবাসীদের কাছে ইসলামী ব্যাংকের প্রতিনিধি গিয়ে হাতে-কলমে শিক্ষা দেয়া হয়। শ্রমিকদের ছুটির দিনে আঞ্চলিক অফিসগুলোতে কাজ করা হয়। ১০ জনের ৭ জন প্রবাসী ইসলামী ব্যাংকে একাউন্ট আছে। করোনাতে ইসলামী ব্যাংকে রেমিটেন্স কমে যায়।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, রিজার্ভ ধরে রাখতে হলে রেমিটেন্সের ওপর নির্ভর করতে হবে। আমদানি কমিয়ে রিজার্ভ ঠিক রাখা সমাধান নয় বরং এ জন্য রেমিটেন্সে জোর দিতে হবে। ব্যাংকগুলোকে টার্গেট দিয়ে দিতে হবে। কেননা যাদের রেমিটেন্স নেই তারা এলসি খুলতে পারছে না। টাকাটা বাংলাদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে হবে। মার্কেটে দুটি ব্যাংকের গ্যাপ কমাতে হবে। অর্থনীতির কালোবাজার বন্ধ না করলে কোন সমাধান হবে না।
আনন্দবাজার/শহক