ঢাকা | শুক্রবার
৮ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২৩শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যা ভাণ্ডে তাই ব্রহ্মাণ্ডে

যা ভাণ্ডে তাই ব্রহ্মাণ্ডে

‘এসব দেখি কানার হাটবাজার

বেদ বিধির শাস্ত্র কানা

আরেক কানা মন আমার’।

লালন সাঁই ছিলেন একাধারে একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, মানবতাবাদী ও সমাজ সংস্কারক। তাঁর গানের মধ্যে সন্ধান পাওয়া যায় এক অনন্য মানব দর্শনের। তিনি লালন ফকির নামেও পরিচিত। মৃত্যুর ১২৯ বছর পর আজও বেঁচে আছেন তাঁর গানের মাঝে। গ্রাম বাংলায় আধ্যাত্মিক ভাবধারায় তাঁর রচিত গান ছড়িয়ে পড়ে লোকের মুখে মুখে।

‘আপন মনে যাহার গরল মাখা থাকে।

যেখানে যায় সুধার আশে সেখানে গরল দেখে’।

নিজের মনে যদি কুটিলতা থাকে তাহলে মানুষ সবখানে জটিলতা দেখতে পায়। কোনো কিছু সহজ ভাবতে পারে না, পজেটিভ ভাবতে পারে না। তাঁর গানের মাধ্যমেই উনিশ শতকে বাউল গান বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তিনি প্রায় দুহাজার গান রচনা করেছিলেন বলে লালন গবেষকদের গবেষণা তথ্য থেকে জানা যায়।

লালন সাঁইর সঠিক জন্ম ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কোনো কোনো লালন গবেষক মনে করেন ১৭৭৪ সালে বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার ভাড়ারা গ্রামে লালন জন্মগ্রহণ করেছিলেন সম্ভ্রান্ত এক হিন্দু কায়স্থ পরিবারে। বাবা মাধব কর ও মা পদ্মাবতীর একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি। কেউ বলেন তাঁর জন্ম ঝিনাইদহে, কেউ বলেন যশোরে।

জানা যায়, শৈশবে পিতৃবিয়োগ হওয়ায় অল্প বয়সেই তাঁর ওপর সংসারের দায়িত্ব এসে পড়েছিল। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের সুযোগ তাঁর হয়নি। কোনো কোনো গবেষকের বিবরণ অনুযায়ী প্রতিবেশী বাউলদাস ও অন্যান্য সঙ্গীদের নিয়ে পুণ্যস্নান সেরে ঘরে ফেরার পথে লালন বসন্তরোগে গুরুতরভাবে আক্রান্ত হন। রোগ বৃদ্ধি পেলে অচৈতন্য লালনকে মৃত মনে করে সঙ্গীরা কোনোরকমে তার মুখাগ্নি করে তাঁকে নদীতে ভাসিয়ে দেয়।

এক মুসলমান রমণী নদীকূল থেকে লালনের সংজ্ঞাহীন দেহ উদ্ধার করে সেবাশুশ্রূষা করে তাঁকে সুস্থ করে তোলেন। কিন্তু তাঁর একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। এরপর বাড়ি ফিরে গেলে সমাজপতি ও আত্মীয়স্বজন মুসলমানের গৃহে অন্নজল গ্রহণ করার অপরাধে তাঁকে সমাজে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ব্যথিত লালন চিরতরে গৃহত্যাগ করেন। বলা হয়, এই ঘটনা সমাজ-সংসার, শাস্ত্র আচার এবং জাতধর্ম সম্পর্কে তাঁকে বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। এবং এখান থেকেই হয় তাঁর নতুন জন্ম।

‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।

লালন কয় জাতের কী রূপ, দেখলাম না এ নজরে’।

বাউল গুরু সিরাজ সাঁইয়ের কাছে দীক্ষা নেওয়ার পর কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়া গ্রামে আখড়া স্থাপন করে তাঁর প্রকৃত সাধক জীবনের সূচনা হয়। ‘যা আছে ভাণ্ডে, তাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে’- এই ছিল লালনের দর্শন। বৈষ্ণব সহজিয়া, বৌদ্ধ সহজিয়া ও সুফিবাদের সংমিশ্রণে মানবগুরুর ভজনা, দেহ-কেন্দ্রিক সাধনাই লালন প্রদর্শিত বাউল ধর্মের মূলমন্ত্র।

লালন ফকির বিশ্বাস করতেন সব মানুষের মধ্যেই বাস করে এক ‘মনের মানুষ’। আর সেই মনের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায় আত্মসাধনার মাধ্যমে। দেহের ভেতরেই সেই মনের মানুষ বাস করেন। লালন ফকিরের যখন আর্বিভাব ঘটেছিল সেই সময়টা বাঙালির জীবনের এক ক্রান্তিকাল। ধর্ম জাত-পাত ইত্যাদি নিয়ে সমাজে ছিল বিভিন্ন সমস্যা।

লালন এই জাত-পাত ও ধর্ম বর্ণ-বিভেদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন একটি জাত ধর্ম বর্ণ গোত্রহীন সমাজ গড়ে তুলতে। সবকিছুর ওপরে তিনি স্থান দিয়েছিলেন মানবতাবাদকে। আজকের বিশ্বে ধর্মান্ধতা, হানাহানি, হিংসা বিদ্বেষ যেভাবে সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, দেশে দেশে ধর্মের নামে যে ভন্ডামি সমাজ ও রাষ্ট্রকে অস্থির করে তুলছে তা থেকে পরিত্রাণ পেতে লালন দর্শন সমাজে ছড়িয়ে দেয়া বিশেষ প্রয়োজন। নতুন প্রজন্মের কাছে লালনের মানবতাবাদী দর্শন তুলে ধরার মাধ্যমে অহিংসার বাণী প্রচার অতীব জরুরি।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ

সংবাদটি শেয়ার করুন