ঢাকা | মঙ্গলবার
১৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
৩০শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মহাকালের না ফোটা ফুল

শেখ রাসেল-

মহাকালের এক না ফোটা ফুল শেখ রাসেল। যার রক্তের সাথে মিশে আছে এদেশের ইতিহাস। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকরা বুলেটে ঝাঁঝরা করেছে নিষ্পাপ শিশু রাসেলের কোমল শরীর। শেখ রাসেলের জন্মদিন ১৮ অক্টোবর এখন ‘জাতীয় দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। ২৩ আগস্ট ২০২১, মন্ত্রিসভার বৈঠকে শেখ রাসেল দিবস ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত দিবস হিসেবে পালনের বিষয়ে অনুমোদিত হয়।
১৯৬৪ সালের কথা। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে চলেছে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা প্রবাহ। সমস্ত পাকিস্তানজুড়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তোড়জোড়। একদিকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান, অন্যদিকে সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহ। বড় অনিশ্চয়তার মধ্যে দেশ। সেই সময় বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘর আলো করে জন্ম নিল এক ছোট্ট শিশু। ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবরে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়িটি আলোকিত করে এলো ফুলের মতো এক শিশু শেখ রাসেল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র শিশু রাসেল পরিবারের সবার আদর ও হৈ হুল্লোড়ে মাতিয়ে রাখতো ৩২ নম্বর বাড়ি। ছোট্ট একটি বাই-সাইকেল নিয়ে ছুটে বেড়াতো বাড়ির আঙিনায়। শিশু রাসেলের বেশি সময় কেটেছে মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে। বাবাকে না পেয়ে মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে আব্বা বলে সম্বোধন করতো রাসেল। রাসেল নামটি রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রিয় লেখক দার্শনিক সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বার্ট্রান্ড রাসেল। তিনি কেবল দার্শনিকই ছিলেন না, বিজ্ঞানীও ছিলেন। ছিলেন পারমাণবিক যুদ্ধবিরোধী।

রাসেলের নামের সঙ্গে মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যের নাম রাখলেন রাসেল। শেখ রাসেল। আশা ছিল তাঁর ছেলে বড় হয়ে একজন বিখ্যাত মানুষ হবে। মানবিক মানুষ। বিবেকবান মানুষ। পরিবারের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য হওয়ার কারণে সকলের আদরের ধন ছিল ছোট্ট রাসেল। রাসেলের জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে বাবাকে ছাড়া। বাবা বন্দী হয়ে কারাগারে ছিলেন দিনের পর দিন।

শেখ রাসেল বেশ কয়েকবারই কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছে। তবে তার প্রথম কারাগার দেখা ১৯৬৬ সালের ৮ মে। কারাগারে দেখা করে আসার সময় রাসেল কিছুতেই তার বাবাকে রেখে আসতে চাইত না। রেখে আসতে ভীষণ মন খারাপ হতো। বঙ্গবন্ধু তাঁর কারাগারের রোজনামচা বইয়ে ১৯৬৬ সালের ১৫ জুনের দিনলিপিতে রাসেলকে নিয়ে লিখেছেন-

‘১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না- যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মালবোঝাই ট্রাক ঢুকেছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভেতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’।
রাসেলের জন্মের সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিলো ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেঝ ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেঝ ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখবো। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালোচুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড় সড় হয়েছিলো রাসেল।’

শিশু রাসেলের অভিমানী হৃদয় সম্পর্কে বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু কারাগারের রোজনামচায় লিখেছেন, ‘জেল গেটে যখন উপস্থিত হলাম ছোট ছেলেটা আজ আর বাইরে এসে দাঁড়াইয়া নাই দেখে আশ্চর্যই হলাম। আমি যখন রুমের ভেতর যেয়ে ওকে কোলে করলাম আমার গলা ধরে ‘আব্বা’‘ আব্বা’ করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে ‘আব্বা’‘ আব্বা’ করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে ‘আব্বা’ বলে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ব্যাপার কী?’ ওর মা বলল, “বাড়িতে ‘আব্বা’‘ আব্বা’ করে কাঁদে তাই ওকে বলেছি আমাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকতে।” রাসেল ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকতে লাগল। যেই আমি জবাব দিই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, ‘তুমি আমার আব্বা।’ আমার ওপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না।’

ছোট রাসেল ছিল বন্ধুবৎসল, গরিবদের জন্য ছিল তাঁর মমতা। পরিবারের সদস্যদের সাথে যখন টুঙ্গিপাড়াতে যেত তখন গ্রামের ছেলেদের জন্য সে জামা কাপড় নিয়ে যেত। তাদের উপহার দিত। ছোটবেলা থেকে বাবাকে কারাগারে দেখতে দেখতে রাসেল অজান্তেই অনেকটা চাপা স্বভাবের হয়ে উঠেছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে বিষয়ে বক্তৃতায় বলেন, ‘খুব চাপা স্বভাবের ছিল। সহজে নিজের কিছু বলত না। তার চোখে যখন পানি, চোখে পানি কেন জানতে চাইলে বলত, চোখে যেন কী পড়েছে। ওইটুকু ছোট বাচ্চা, নিজের মনের ব্যথাটা পর্যন্ত কীভাবে লুকিয়ে রাখতে হয় শিখেছিল।’

‘কারাগারের রোজনামচা’য় শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন ‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো। কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলে-মেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’

শেখ রাসেলের এই ছোট্ট জীবন আমাদের জন্য অনেক শিক্ষণীয়। প্রথমত, আমাদের শিশুরা যদি শেখ রাসেলকে আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করে তাঁর মতো বেড়ে ওঠে, তাহলে আমরা আদর্শ শিশু পাব। যাদের হাত ধরে বিনির্মিত হবে আগামী দিনের চেতনার নাগরিক। শিশুদের তাই শেখ রাসেলের ছোট্ট জীবনটা জানাতে হবে। যাতে শিশুরা অনাবিল সুন্দরের সৌন্দর্যে বেড়ে ওঠে, হাসতে পারে, খেলতে পারে, দুষ্টুমি করতে পারে, বন্ধুত্ব করতে পারে, গরিব মানুষকে ভালোবাসতে পারে। এভাবে যদি প্রতিটি শিশু বেড়ে ওঠে তাহলে এই শিশুরা বড় হয়ে আলোকিত মানুষ হতে পারবে। শেখ রাসেল এ প্রজন্মের শিশুদের জন্য অণুকরনীয় হতে পারে নিঃসন্দেহে।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ

আনন্দবাজার/শহক

সংবাদটি শেয়ার করুন