ব্রিটিশ শাসনামলের পর বৃহত্তর নোয়াখালীর (নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী) একমাত্র বাণিজ্যিক কেন্দ্র বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনীতে গড়ে উঠেছিল ৩৬টি সরিষা তেলের মিল। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে মাত্র ১২ জোড়া মেশিন ও ২২ জন শ্রমিক নিয়ে চৌমুহনীর মহেশগঞ্জ এলাকায় গড়ে উঠে ‘মেঘনা অয়েল মিলস্’। তৎকালিন ওই মিলস্ পরিচালনা করতেন মো. আলী আজম ভূঁইয়া। দীর্ঘ ৩৫ বছর মিলস্ পরিচালনার পর মারা যাওয়ার পর ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নেন তার ছেলে মহিউদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া মাহিন। দায়িত্ব পাওয়ার প্রায় এক যুগ পরিচালনার পর করোনাকালীন কাঁচামাল ও জনবল সংকটে একবারে বন্ধ হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। এরপর আর্থিক সংকটের কারণে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
‘মেঘনা অয়েল মিলস্’ এর পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া মাহিন জানান, ২০০৭ সালে মিলস্ এর দায়িত্ব নেওয়ার পর ২৬ জোড়া ঘানি মেশিন নিয়ে সরিষা তেল উৎপাদন শুরু করেন। তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন প্রায় ৮০ জন শ্রমিক। প্রথম দিকে প্রতিদিন ২৫০০ কেজি সরিষার তেল উৎপাদন এবং বিক্রি হতো। ২০১০ সালের দিকে এসে বাজারে সয়াবিন তেলের প্রচার-প্রচারণা ও মূল্য কমের কারণে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কমতে থাকে সরিষা তেলের চাহিদা। সে সময়ে দিনে উৎপাদন নেমে আসে গড়ে প্রতিদিন ১৫০০-১৭০০ কেজিতে। ২০১৭ সালে তা নেমে আসে ৬০০-৭০০ কেজিতে। পরের বছরে উৎপাদন হয় মাত্র ৪০০ কেজি করে। ২০১৯ সালের দিকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে কমতে থাকে কাঁচামাল (সরিষা) আমদানি। একই সঙ্গে উৎপাদন কমতে থাকায় ছাঁটাই করা হয় শ্রমিকদের। ওই বছরের মাঝামাঝিতে একবারে বন্ধ করে দেওয়া হয় প্রায় অর্ধশত বছরের মিলটি।
তথ্যমতে, করোনাকালীন সয়াবিন তেলে মানবদেহে ক্ষতির বিষয়টি জানার পর ২০২১ সালের শেষের দিকে মানুষের মধ্যে সরিষা তেলের চাহিদা বাড়তে থাকে। তবে চাহিদা বাড়ার বিপরীতে তেলের উৎপাদন বাড়েনি। এমন পরিস্থিতিতে মেঘনা অয়েল মিলটি ফের চালু করার চেষ্টা করা হয়। তবে বার বারই নানা সংকটে ব্যর্থ হতে থাকেন পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, অর্থনৈতিক সংকট, কম সুদে ঋণ না পাওয়া, সরকারি প্রণোদনা ও জনবল সংকটে একাধিকবার চেষ্টার পরও চালু করা যাচ্ছে না। মানুষের স্বাস্থ্য ও শারীরিক বড় ধরনের রোগ-ব্যধি রোধে সরিষা তেলের মিলগুলো চালু করতে সরকারের সহযোগিতা ও ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করার আহবান জানান তিনি।
চৌমুহনী বাজার ঘুরে সরিষা মিল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাজার জোড়া কাঠের ঘানির খট খট শব্দ এক সময় চৌমুহনীর মানুষের কাছে ছিলো ছন্দের মতো। শ্রমিক আর ক্রেতাদের পদচারণায় মুখর থাকতো এখানকার সরিষা তেলের মিলগুলো। স্বাধীনতার আগে এবং পরে দেশের প্রায় সব বাজারই ছিলো চৌমুহনীর সরিষা তেলের দখলে। গুণে ও মানে প্রসিদ্ধ থাকলেও বর্তমানে ঐতিহ্য হারিয়েছে এখানকার সবকটি ঘানি বা মিলা।
মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব ও স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে দেশের বাজারে মানে ও গুণে প্রসিদ্ধ ছিলো নোয়াখালীর বাণিজ্যকেন্দ্র চৌমুহনীর ঘানিভাঙা সরিষা তেল। যাদের মধ্যে অন্যতম ছিল, শ্রী গোবিন্দ অয়েল মিলস্, শ্রী দূর্গা অয়েল মিলস্, আদর্শ অয়েল মিলস্, মতি অয়েল, গৌর অয়েল মিলস্, নবযুগ অয়েল মিলস্, মেঘনা অয়েল মিলস্, শ্রী গোপাল অয়েল মিলস্, ডালিয়া অয়েল মিলস্, আজমীর অয়েল মিলস্, গনেশ অয়েল মিলস্, যমুনা অয়েল মিলস্, বাল্ব মার্কা অয়েল, পপুলার অয়েল মিলস্ ও রোকেয়া অয়েল মিলস্।
প্রায় ৫০ বছর দাবড়িয়ে বেড়ানো এ শিল্প এখন বিলুপ্তি প্রায়। সয়াবিন তেলের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতা, পুঁজি আর কাঁচামাল সংকটে বন্ধ হচ্ছে মিলগুলো। ১৯৯০ সালের পর থেকে মালিক পরিবর্তনসহ বিভিন্ন সংকট বন্ধ হয়েছে ৩২টি সরিষা তেলের ঘানি। চৌমুহনীতে বর্তমানে চালু রয়েছে নবযুগ অয়েল মিলস্, বাল্ব মার্কা অয়েল, রোকেয়া অয়েল মিলস্ ও শ্রী গোপাল অয়েল মিলস্। মিল মালিকদের মতে, মিলগুলো চালু থাকলেও গ্রাহকের চাহিদা মতো তেল উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না।
মালিকদের দেওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে জেলায় সরিষা তেলের চাহিদা রয়েছে প্রতিদিন ১৫ হাজার কেজির বেশি। কিন্তু সে তুলনায় ৪টি ঘানিতে উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৩৫০০ কেজি সরিষা তেল, যা চাহিদার মাত্র চার ভাগের এক ভাগ। ফলে ঢাকা, ফেনী ও লাকসামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ও বড় বড় ব্যান্ডের তেলগুলো দিয়ে জেলার চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। বর্তমানে ঘানিগুলো থেকে উৎপাদিত তেল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৩০ টাকা করে। প্রতিমাসে সাড়ে ১০ কোটি টাকার তেলের চাহিদা থাকলেও সেই হিসেবে চারটি ঘানিতে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র আড়াই কোটি টাকার সরিষা। সরকারি সহযোগিতা ফেলে সরিষার এই চাহিদার পুরোটাই জেলার ঘানিগুলোতে উৎপাদিত তেল দিয়ে সম্ভব হতো। এর বাইরে এখানে উৎপাদিত তেল জেলার বাইরে বিক্রি করা সম্ভব বলে মনে করছেন তারা।
ঘানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আশির দশক পরবর্তী চটকদার বিজ্ঞাপন ও স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিমুক্ত বলে সয়াবিন তেলের ব্যাপক প্রচারণায় বাজার থেকে ছিটকে পড়তে থাকে সরিষা তেলের চাহিদা। ফলে লোকসানে পড়ে ধীরে ধীরে পুঁজি হারাতে থাকেন মালিকরা। সঙ্গে প্রকট আকার ধারণ করে কাঁচামাল, পুঁজি ও শ্রমিক সংকটও। এছাড়াও বিএসটিআই-এর লাইসেন্স জামেলা ও বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিলের কারণে হয়রানির শিকার হয়ে অনেকেই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করেছেন। এছাড়াও কাঁচা সরিষার চাহিদার তুলনায় শতকরা মাত্র ২০ ভাগ উৎপাদন হয় দেশে, বাকি ৮০ ভাগ কাঁচা সরিষা আনতে হয় ফ্রান্স, কানাডা, চীন, রাশিয়া, ইউক্রেনসহ বাহিরের দেশ থেকে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে স্বল্পসুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করে বন্ধ মিলগুলো চালু করা সম্ভব মনে করছেন মিল মালিকরা।
সাধারণ ক্রেতাদের মতে, বিজ্ঞাপনে প্রচার-প্রচারণার কারণে গত বছরে সয়াবিন তেল ব্যবহার করলেও এখন রান্নার বড় কাজে সরিষার তেলের ব্যবহার বাড়িয়েছেন তারা। দাম বেশি হলেও গুণগতমান ভালো হওয়ায় এখনও সরিষা তেলে ভরসা তাদের। কাঁচামালে উৎপাদন হওয়ায় সরিষার তেল স্বাস্থ্যসম্মত।
সচেতন মহল বলছে, দেশের কৃষিতে সরিষার আবাদ বাড়ানোর পাশাপাশি তেল উৎপাদনে মিলগুলো সচল রাখতে সরকারি নজরদারি বাড়ালে উৎপাদক উদ্যোক্তাদের হাত ধরে ঘুরে দাঁড়াবে এ শিল্পটি।
জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, চৌমুহনীর ঘানি থেকে তৈরি সরিষা তেলের নাম-ডাক দীর্ঘদিন থেকে। বর্তমানে বাজারে সরিষা তেলের চাহিদাও অনেক বেড়েছে। আমরা ব্যবসায়ী নেতা ও ঘানি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে বন্ধ থাকা ঘানি মালিকদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সহযোগিতা করবো। এছাড়াও যাদের স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণের প্রয়োজন আমরা সে বিষয়ে তাদের সহযোগিতা করবো।