ঢাকা | শুক্রবার
৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রপ্তানি বাণিজ্যে ব্রুনাই

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে বাংলাদেশের। এ সম্পর্ককে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে বিষয়টিকে ভিত্তি ধরে অর্থনৈতিক কূটনীতি বিষয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করছে দৈনিক আনন্দবাজার। আজ প্রকাশিত হলো বাংলাদেশ-ব্রুনাই দারুসসলামের পণ্য রপ্তানি নিয়ে প্রথম প্রতিবেদন ‘রপ্তানি বাণিজ্যে ব্রুনাই’।

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার স্বাধীন রাষ্ট্র ব্রুনাই দারুসসলামের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৮৪-৮৫ অর্থবছরে। সে বছর ৫৯ মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে বাজারটিতে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। দুই অঙ্কের রপ্তানি বাণিজ্য দিয়ে শুরু করা বাজার ৪ বছরে রপ্তানি নেমে আসে ১ মার্কিন ডলারের ঘরে। এমনকি ৩ বছর কোনো কানাকড়িও রপ্তানি হয়নি। তিন অঙ্কের ঘরে আসতে সময় লাগে ২৬ বছর। তখন পণ্য রপ্তানি হয়েছিল ৩০৮ মার্কিন ডলার।

অবশ্য এখন চিত্র পাল্টে গেছে। কেননা ব্রুনাই দারুসসালামে ২০২১-২২ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে সিরিয়াল, ময়দা, মাড় বা দুধের প্রস্তুতকৃত পণ্য। যা ৭ লাখ ৭৮ হাজার ৩৬৩ দশমিক ৫২ মার্কিন ডলার মূল্যের। গতবছরটিকে ব্যবসায়ীরা স্মরণীয় করে রাখতেই পারেন। কেননা ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৭ লাখ ৬১ হাজার ১৪ দশমিক ৪২ মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়েছে দেশটিতে।

দেশটিতে নতুন করে বাজার খোঁজতে অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ। ২০১৯ সালের ২১-২৩ এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশটিতে সরকারি সফরে গিয়ে ৭টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেন। এসব সমঝোতা স্মারকের মধ্যে কৃষি ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি সহযোগিতার বিষয়ে, মৎস্য ক্ষেত্রে সহযোগিতা, পশুসম্পদ ক্ষেত্রে সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক ও শিল্প সহযোগিতা সম্পর্কিত, যুব ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে সহযোগিতা, এলএনজি সরবরাহে সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্পর্কিত সমঝোতা স্মারক এবং কূটনৈতিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্ট হোল্ডারদের জন্য ভিসার ছাড় সংক্রান্ত বিনিময় নোট।

সেই সফরের পর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের আমন্ত্রণে ব্রুনাই দারুসসালামের সুলতান হাজি হাসানাল বলকিয়াহ সরকারি সফরে আগামী ১৫ হতে ১৭ অক্টোবরে বাংলাদেশে আসছেন। ব্রুনাই ১৯৮৪ সালে স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পর বাংলাদেশ ও ব্রুনাই এর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ১৯৯৭ সালে ব্রুনাই-এ বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন পুনঃস্থাপনের পর হতে দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও পারস্পরিক সহযোগিতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত বিগত এক যুগে ব্রুনাইয়ের সাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবি’র দেয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে ব্রুনাইয়ে যেসব পণ্য রপ্তানি হয় তার মধ্যে রয়েছে- ১. দুগ্ধজাত পণ্য, ২. পাখির ডিম, ৩. প্রাকৃতিক মধু, ৪. পশু উৎপত্তির ভোজ্য পণ্য, ৫. দুধ, ৬. ক্রিম, ৭. মিষ্টি, ৮. মাখন, ৯. চর্বি এবং তেল, ১০. ভোজ্য সবজি, ১১. আলু, ১২. বীজ আলু,  ১৩. কফি, ১৪. চা, ১৫. মশলা, ১৬. মরিচ, ১৭. ক্যাপসিকাম প্রজাতির ফল, ১৮. আদা, ১৯. জাফরান, ২০. হলুদ, ২১. তরকারি এবং অন্যান্য মশলা, ২২. সিরিয়াল, ২৩. চাল (ধান বা রুক্ষ), ২৪. ভুসি (বাদামী) চাল, ২৫. গম-ময়দার আটা, ২৬. তেল বীজ এবং অলিজিনাস ফল, ২৭. শিল্প বা ঔষধি গাছ, ২৮. খড় এবং পশুখাদ্য, ২৯. সুগন্ধি, ৩০. ফার্মেসিতে ব্যবহৃত গাছপালা এবং গাছের কিছু অংশ, ৩১. কীটনাশক, ৩২. সরিষার তেল, ৩৩. চিনি এবং চিনি মিষ্টান্ন, ৩৪. চুইংগাম, ৩৫. পাস্তা, যেমন স্প্যাগেটি, ম্যাকারনি, নুডুলস, লাসাগন ইত্যাদি, ৩৬. মিষ্টি বিস্কুট, ৩৭. টিভি, ৩৮. ফলের রস (আঙ্গুর সহ) এবং উদ্ভিজ্জ রস, ৩৯. সবজির জুস।

এছাড়াও রয়েছে ৪০. জল (খনিজ এবং বায়ুযুক্ত), ৪১.  লবণ, ৪২. সালফার, ৪৩. পাথর, ৪৪. প্লাস্টারিং উপকরণ, লির্ন এবং সিমেন্ট, ৪৫. বিশুদ্ধ সোডিয়াম ক্লোরাইড, ৪৬. সমুদ্রের জল, ৪৭. খনিজ জ্বালানি, ৪৮. বিটুমিনাস পদার্থ; খনিজ মোম, ৪৯. পেট্রোলিয়াম জেলি, ৫০. সাবান, ৫১. মোমবাতি এবং অনুরূপ, ৫২. ন্যাপথালিন বল, ৫৩. মশার কয়েল, এরোসল; মশা তাড়ানোর ঔষধ, ৫৪. কাগজ বা পেপারবোর্ড; কাগজের সজ্জা, ৫৫. তুলা, ৫৬. পোশাক এবং পোশাক আনুষাঙ্গিক, ৫৭. পুরুষদের বা ছেলেদের ট্রাউজার, ইত্যাদি, ৫৮. টি-শার্ট, সিঙ্গলেট এবং অন্যান্য ভেস্ট, ৫৯. জার্সি, পুলওভার, ৬০. মহিলাদের বা মেয়েদের স্যুট, জ্যাকেট, পোশাক, স্কার্ট, ইত্যাদি, ৬১. সিরামিক পণ্য, ৬২. টেবিলওয়্যার, কিথেনওয়্যার, অন্যান্য গৃহস্থালী সামগ্রী, চীনামাটির বাসন ইত্যাদি।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৪-৮৫ অর্থবছরে ৫৯ মার্কিন ডলার পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে ব্রুনাইয়ের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি শুরু হয়। ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছরে তা নেমে আসে ৩৫ মার্কিন ডলারে। ১৯৮৭-৮৮ অর্থবছরে তা তলানিতে চলে যায় মাত্র ১০ মার্কিন ডলারে। ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে কিছুটা বেড়ে ৮০ মার্কিন ডলারে। ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরে ফাঁকা।

১৯৯০-৯১ অর্থবছরে কিছুটা বেড়ে ৮৪ মার্কিন ডলারে। ১৯৯১-৯৪ অর্থবছরে পর্যন্ত প্রতিবছর মাত্র ১ মার্কিন ডলারের করে পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ৪ বছর পর ৫৮ মার্কিন ডলার বৃদ্ধি পেয়ে ৫৯ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয় ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে। পরের বছর ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে তা ৫১ মার্কিন ডলার কমে ৮ মার্কিন ডলার হয়ে যায়। এর পরের বছর ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে তা ৫০ মার্কিন ডলার বৃদ্ধি পেয়ে ৫৮ মার্কিন ডলারে দাঁড়ায়।

১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ৯৭ মার্কিন ডলারে উন্নীত হলেও ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে আবার যেই লাউ সেই কদু অর্থাৎ ৮ মার্কিন ডলারে নেমে আসে। পরের বছর ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে কিছুটা বেড়ে ১৪ মার্কিন ডলার হয়। ১৯৮৪-৮৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ১৬ বছরেও তিন অঙ্কের ঘরে পৌঁছাতে পারেনি রপ্তানি। এর মধ্যেও হতাশ না হয়ে বাণিজ্য অব্যাহত রাখেন ব্যবসায়ীরা। ১৯৮৪-৮৫ থেকে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছর পর্যন্ত ১৬ বছরে সর্বোচ্চ বছরে ৯৭ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হয়। এই ১৬ বছরে ৪৩১ মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়।

২০০০-০১ অর্থবছরে রপ্তানির কোনো হিসেব পাওয়া না গেলেও ইপিবির তথ্যমতে, ২০০১-০২ অর্থবছরে ৩২, ২০০২-৩ অর্থবছরে ৮১ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে। সাপ-লুডু খেলার মতো ২০০৩-৪ অর্থবছরে ৭ মার্কিন ডলার। ২০০৪-৫ অর্থবছরে চার গুণ বেড়ে ৩১ মার্কিন ডলার হয়। এবার ২০০৫-৬ অর্থবছরে পায় আলোক গতি। এর বছরে রপ্তানি হয় ৩০৮ মার্কিন ডলার। ৫ গুণ কমে ২০০৬-৭ অর্থবছরে ৫৫ মার্কিন ডলার হয়।

২০০৭-৮ অর্থবছরে কিছুটা বেড়ে ৬৯ ও ২০০৮-৯ অর্থবছরে ১০৩ মার্কিন ডলার রপ্তানি করে তিন অঙ্কের কোঠায় যায়। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৯০ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। ২০০০-০১ থেকে ২০০৯-১০ অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩০৮ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। আর এর মাধ্যমেই দীর্ঘ ২৬ বছর পরে তিন অঙ্কের ঘরে পৌঁছায় রপ্তানি আয়। ২০০০-১ থেকে ২০০৯-১০ অর্থবছর পর্যন্ত ৭৭৬ মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০-১১ অর্থবছরে ৯৭ ও ২০১১-১২ অর্থবছরে ১৯১ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয় দেশটিতে। ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। এ বছর ৩৭৩, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫৪৮, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৬৬৯ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। বিপ্লব ঘরে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে। তখন রপ্তানি দ্বিগুণ হয়ে ১২৩৫ মার্কিন ডলার হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১২২২ মার্কিন ডলার, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১১১৮ দশমিক ৩৮ মার্কিন ডলার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৫৬৩.১৪ মার্কিন ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৩৫৫ দশমিক ২৬ মার্কিন ডলার এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৭৬১ দশমিক ০১ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়।

২০১০-১১ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরের মধ্যে ১০১৩২ দশমিক ৭৯ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ২০১০-১১ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে সবচেয়ে ১৭৬১ দশমিক ০১ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। তবে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৭ লাখ ৬১ হাজার ১৪ দশমিক ৪২ মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়। ৩৮ বছরে মোট পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১৭ লাখ ৭২ হাজার ৩৫৪ দশমিক ২১ মার্কিন ডলার। ১৯৮৫-৮৬, ১৯৮৯-৯০, ২০০০-১ এই তিন অর্থবছরে একটি কানাকড়িও রপ্তানি হয়নি ব্রুনাইয়ের বাজারে।

সংবাদটি শেয়ার করুন