ঢাকা | শুক্রবার
১৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্মার্ট কৃষিতে তরুণরা

স্মার্ট কৃষিতে তরুণরা

উৎপাদনশীলতা ও গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে কৃষি। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে শতাধিক সবজি উৎপাদন হলেও সময়, জাত এবং সঠিক নিয়ম না জানায় অধিকাংশ কৃষক আগাম সবজি সঠিক সময় ঘরে তুলতে পারেন না। তবে আশার দিক হলো, কৃষিতে আধুনিক পদ্ধতি প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। বেশ কিছু অঞ্চলে ইতোমধ্যে পরিবর্তন হচ্ছে চাষাবাদের ধরণ। দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে আধুনিক কৃষি উন্নয়ন বেশ জরুরি।

উত্তরাঞ্চলের রাজধানী খ্যাত বগুড়ায় শুরু হয়েছে আধুনিক ও উন্নত পদ্ধতিতে সবজি চারা উৎপাদন প্রক্রিয়া। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি অনেক উদ্যোক্তা নিয়েছেন স্মার্ট কৃষি উদ্যোগ। ইতোমধ্যে আধুনিক পদ্ধতিতে বগুড়ায় উৎপাদিত এ চারা সাড়াও ফেলেছে। উৎপাদিত চারা সরবরাহ করা হচ্ছে দেশব্যাপী। এমন পদ্ধতির কারণে লাভবান হচ্ছেন নতুন এই উদ্যোক্তারা। চাষাবাদে নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন কৃষকরা। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণরা বেশ আগ্রহের সঙ্গে ঝুঁকছেন স্মার্ট কৃষিতে।

কৃষি চারা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আধুনিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় চারা উৎপাদন করে থাকেন। প্রথমে নারিকেলের ছোলায় তৈরি কোকোপিটের সাথে জৈব সার ও বিভিন্ন কাঁচামাল মিশিয়ে তৈরি হয় মিডিয়া। এরপর ট্রেতে বীজপূর্ণ হিপের মাধ্যমে জার্মিনেশন করা হয়। এর কিছুদিন পর জন্মানো নতুন চারা আলাদা ট্রেতে স্থানান্তর করা হয়। এভাবেই চারাগুলো অতিযত্নে অক্ষত ও সুস্থ সবলভাবে একই মাপে বড় হতে থাকে। মাটির সংস্পর্শ না থাকায় শতভাগ শিকড়যুক্ত হয় চারাগুলো। যার ফলে এসব চারা শক্তিশালী হওয়ায় দ্রুত তুলনামূলক ভালো ফলন পান কৃষকরা। অল্প সময়ে স্বল্প খরচে উৎপাদন হয় কাঙ্ক্ষিত ফলন। রোদ ও বৃষ্টিপাতে ক্ষতির আশঙ্কা থেকে চারাগুলো রক্ষা করতে পলিহাউজে শেডনেটের মাধ্যমে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

স্মার্ট পদ্ধতিতে ব্যবসায়িকভাবে সবজি চারা উৎপাদনে অল্প সময়েই এগিয়ে যাচ্ছে বগুড়ার এ প্রতিষ্ঠানগুলো। কৃষকদের আস্থার অপর নাম হয়েছে সবজি চারা উৎপাদনকারী এসব প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে আধুনিক পদ্ধতিতে উৎপাদিত চারাগুলো দৃষ্টি কাড়ছে কৃষকদের।

বগুড়ায় আধুনিক সবজি চারা উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম ম্যাক্সিম এগ্রো, এগ্রো ওয়ান, জার্ম প্লাজমা সেন্টার। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সবজি চারা নিয়ে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। তারা বলছেন, ইতোপূর্বে মাটিতে উৎপাদিত চারাগুলো অনেক সময় নষ্ট হতো, ফলনও ছিল হতাশাজনক। তবে ট্রে পদ্ধতিতে উৎপাদিত মজবুত চারাগুলো রোপনের পর মারা যায় না, দ্রুত বড় হয়। ফলে অতীতের চেয়ে কম খরচে উৎপাদিত পণ্য অধিক দামে বিক্রি করা যায়। এখন এমন মানসম্মত চারা ব্যবহার করতেই বেশি আগ্রহী কৃষকরা।

জার্ম প্লাজমা সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাকিল আহমেদ বলেন, আদি পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনের ফলে প্রায় ৭০ শতাংশ নষ্ট হয়। এতে দেশের কৃষকরা ব্যাপকবাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। আমরা আধুনিক পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ মাটির সংস্পর্শ ছাড়াই কোকোডাস্টের মাধ্যমে চারা তৈরি করে থাকি। এক্ষেত্রে কৃষক সম্পূর্ণ অক্ষত শতভাগ শিকড়যুক্ত চারা পান। যার ফলে চারার মৃত্যুহার থাকে শূন্য শতাংশ। একই সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত ফলনও পান কৃষক।

আধুনিক এসব কৃষি প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্বভাবে চারা উৎপাদন ছাড়াও বীজ, কোকোপিট ও কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে থাকে। এছাড়া এগ্রো ওয়ান প্রতিমাসে স্মার্ট ফার্মার ট্রেইনিং প্রোগ্রাম করে থাকে। যেখানে অংশগ্রহণ করেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষি উদ্যোক্তারা। প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সামিউল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশের উন্নয়নে কৃষি উন্নয়নের বিকল্প নেই। এই লক্ষ্যে আমরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের প্রশিক্ষিত করি বগুড়া থেকে। এর ফলে তৈরি হচ্ছে স্মার্ট ফার্মার, তৈরি হচ্ছে নতুন উদ্যোক্তা।

উদ্যোক্তারা বলছেন, পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রেক্ষাপটে বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে পুরোনো পদ্ধতি উপেক্ষা করে আধুনিক স্মার্টধারায় চারা উৎপাদনে আবহাওয়া পরিবর্তনের তেমন প্রভাব পড়ে না। আর তাই কৃষকরা যেকোনো প্রতিকুল আবহায়াতেও পাচ্ছেন কাঙ্ক্ষিত আগাম ফলন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনোপ্রকার মাটির সংস্পর্শ না থাকায় চারাগুলো সম্পূর্ণ মাটিবাহিত রোগমুক্ত থাকার নিশ্চয়তা থাকে। এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত চারা থেকে সাধারণ চারার চেয়ে অন্তত ১০ দিন আগে কৃষক চূড়ান্ত ফলন পান। আধুনিক পদ্ধতিতে সবজি চারা উৎপাদনকারী এসব সিডলিং প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করা হয় বিশ্বমানের প্রযুক্তি। ফলে চারাগুলো হয় সম্পূর্ণ সুস্থ, সবল ও মানসম্মত। পলিহাউজ পদ্ধতির কারণে বাইরের কোনো প্রকার পোকা-মাকড় চারা উৎপাদন প্রক্রিয়া সীমানার ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। এতে প্রক্রিয়াধীন চারাগুলো থাকে ভাইরাস বা সংক্রমণমুক্ত। রোপনের পর চারা থেকে ঝুঁকিমুক্তভাবে উৎপাদন হয় সবজি। মাটিতে উৎপাদিত চারার চেয়ে তাদের তৈরি চারাগুলো সুস্থ-সবল হওয়ায় দ্রুত আশানুরূপ ফলন দিতে সক্ষম হয়।

আধুনিক পদ্ধতিতে ফসল উৎকানকারী স্মার্ট কৃষক আলী হোসেন বলেন, আমি আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন করে গ্রাফটিং চারায় টমেটো লাগিয়েছি। আগের তুলনায় ভালো ফলন পাচ্ছি। আশেপাশের কৃষকরাও আমার ফলন দেখে বেশ অবাক হচ্ছে।

কৃষকের চাহিদা ও আগ্রহের প্রতি খেয়াল রেখে চারা উৎপাদককারী প্রতিষ্ঠানগুলো পুরনো পদ্ধতিতে মাটিতে উৎপাদিত চারার মতই প্রায় কাছাকাছি মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। দেশব্যাপী এসব সবজি চারা বাজারজাতকরণে প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে জনবল নিয়োগের মাধ্যমে মার্কেটিং টিম ও পাশাপাশি আধুনিক মার্কেটপ্লেস অনলাইনে পণ্যের নান্দনিক প্রচারণার মাধ্যমে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে। চারা সরবরাহের পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠান কৃষকের জন্য মালচিং, সিডলিং ট্রে, রেডি কোকোপিট, পলি হাউজের জন্য সেডনেট ও পলিফ্লিমসহ বিভিন্ন প্রকার আধুনিক কৃষি উপকরণও দিয়ে থাকে।

তবে বগুড়ার অসংখ্য কৃষক ও চারা উৎপাদনকারী এখনো রয়েছেন আধুনিক এই পদ্ধতির ছোঁয়ার বাইরে। বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ ও সঠিক নির্দেশনার অভাবে অনেকটাই পিছিয়ে আছেন। তারা পুরোনো পদ্ধতিতেই মাটিতে বীজতলা তৈরির মাধ্যমে চারা উৎপাদন করছেন। বৃষ্টিপাতসহ বিভিন্ন প্রতিকুল পরিস্থিতির মোকাবেলাও করতে হয় পুরোনো পদ্ধতিতেই। পড়তে হয় বিভিন্ন জটিলতায়। অবশ্য পরিস্থিতি মোকাবেলা ও প্রতিকারে তারাও বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন নিয়োজিত কর্মিদের মাধ্যমে। পুরোনো পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনকারী ব্যবসায়ী ও কৃষকরাও চেষ্টা করছেন নিজেদের আধুনিকায়ন করতে। সব মিলিয়ে তারা আধুনিক পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন ও সরবরাহ কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে সরকারি প্রশিক্ষণ পেলে তারা উন্নত পদ্ধতিতে কাজ করতে পারবেন মনে করছেন অনেকে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বগুড়ার উপপরিচালক দুলাল হোসেন বলেন, কৃষিতে আধুনিকতার ছোঁয়া এ ক্ষেত্রটি আরও এগিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ কৃষকরাও স্মার্ট কৃষিতে ঝুঁকছেন। ফলে পরিশ্রম ও ব্যয় কম হওয়ায় বেশ লাভবান হচ্ছেন তারা। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবে যারা স্মার্ট কৃষিতে কাজ করছে তাদের জন্য সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টি অবশ্যই থাকবে।

বিশ্বে যত ধরনের প্রযুক্তি আছে তার প্রায় সবই আমাদের কৃষিতে এসে গেছে এবং ব্যবহৃত হচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে দেশীয় বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত বিভিন্ন ধরনের বীজ, যন্ত্রপাতি ও পদ্ধতি। দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ প্রান্তিক কৃষক, যাদের ভূমির পরিমাণ অর্থনৈতিক জোতের আকারের অনেক নিচে। তারা মূলত বর্গা বা ভাগচাষি। বাকি ৩০ শতাংশের মালিকানাধীন ভূমির পরিমাণ মোটামুটিভাবে অর্থনৈতিক জাতের কাছাকাছি। বিভিন্ন কৃষি উপকরণ ও উৎপাদিত ফসলের বাজার মূলত তারাই নিয়ন্ত্রণ করে।

ফলে আমাদের প্রান্তিক কৃষকরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও লাভবান হতে পারছেন না। তবে উদ্যোক্তারা মনে করছেন, সময়ের চাহিদাতেই দেশে কৃষিতে বিপ্লব ঘটছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সারাদেশে আধুনিক সবজি চারা উৎপাদন জনপ্রিয় হবে। উন্নয়ন ঘটবে দেশের অর্থনীতিতে।

সংবাদটি শেয়ার করুন