ঢাকা | শুক্রবার
২৯শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১৪ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিশ্বের সঙ্গে তালহীন

বিশ্বের সঙ্গে তালহীন

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে খাদ্যপণ্যসহ সাব সামগ্রীর বাজার হু হু করে বেড়ে গিয়েছিল। সেই আন্তর্জাতিক বাজারে গম, চিনি, ভোজ্যতেল ও মসুর ডালসহ খাদ্যপণ্যের দাম কমতে শুরু করলেও দেশের বাজারে তার কোন বাতাস নেই। এক কেজি মোটা চাল কিনতেও দিতে হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকা, এক কেজি আটার দাম ৬০ টাকা। এক কেজি করলা ৮০টাকায় কিনেছেন শিবলু। ঢেরস ৬০, কচুরমুখি ৬০, টমেটো ১২০ টাকা। সবচেয়ে কম দামের সবজি পেঁপে কিনতে হয় ৩০-৩৫ টাকা কেজি প্রতি। সেক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও রাজধানী ঢাকায় তার কোনো প্রভাব পড়েনি।

রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধকালে খাদ্যশস্য রপ্তানির জন্য কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলো খুলে দিতে জাতিসংঘ-সমর্থিত একটি চুক্তি সইয়ের সুফল পেতে শুরু করেছে সমগ্র বিশ্ব। বাংলাদেশও সে থেকে বাইরে থাকার কথা নয়। তবে সরকারের গণমুখী উদ্যোগের কারণে কিছু চাল, ভোজ্যতেল বিশেষ করে সয়াবিন ও পাম অয়েলের সামান্য কমেছে। স্থিতিশীল রয়েছে মসুর ডালের দাম।

ব্যবসায়ীদের আপত্তির মুখে সরকার চিনির দাম কমিয়েছে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধের প্রভাবে সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা ও দুর্ভিক্ষের পদধ্বনির মাঝেই খাদ্যশস্য রফতানির জন্য কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলো খুলে দিতে সম্মত হয় দুই দেশ। গত ২২ জুলাই জাতিসংঘ-সমর্থিত চুক্তিটি সই করেছে রাশিয়া ও ইউক্রেন।

আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলোর তথ্য বলছে, ইতোমধ্যে বিশ্ববাজারে গমের দাম কমেছে ৩ থেকে ৪ শতাংশ। দেশেও পাইকারি পর্যায়ে দুই-একটি ব্র্যান্ডের আটা-ময়দার দাম কিছুটা কমেছে। ৫০ কেজির প্রতি বস্তা আটার দাম ২ হাজার ১শ’ টাকা থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭শ’ টাকা। খুচরা বাজারে এর প্রভাব এখনো পড়েনি। দেশে গম আমদানির অন্যতম উৎস রাশিয়া ও ইউক্রেন। সবশেষ ভারত থেকে গম আমদানি বন্ধের পর স্থানীয় বাজারে লাফিয়ে বাড়তে থাকে আটা-ময়দা এবং এ দিয়ে তৈরি পণ্যের দাম।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন রাষ্ট্রীয় বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবি’র হিসাব মতে, এক বছরে আটা-ময়দার দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ৫৬ ভাগ। গত সপ্তাহেও বেড়েছে এই দুটি পণ্যের দাম।

আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম কমছে। আগস্টে (২৬ আগস্ট) আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন গমের দর ছিল ৩৬৫ দশমিক ৯৭ ডলার। সেপ্টেম্বরে সেই গম বিক্রি হয়েছে ৩৫৬ দশমিক ৭৮ ডলার দরে। সে হিসেবে কমেছে ৯ দশমিক ১৯ শতাংশ। একবছর আগে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন গম বিক্রি হয়েছে ৩৩৮ দশমিক ৭৮ ডলার দরে। এক বছরের ব্যবধানে গমের দাম ৮ দশমিক ০৩ শতাংশ বাড়লেও গত আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে দমের দাম কমেছে ২ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

খাদ্য বিভাগের গত আগস্টের তথ্য বলছে, বর্তমানে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৭৬০ টন গম মজুত রয়েছে দেশের সরকারি খাদ্য গুদামগুলোতে। তবে গত বছরের একই সময়ে গমের মজুত ছিল ২ লাখ ৪০ হাজার ৪১০ মেট্রিক টন। চলতি অর্থবছরের ৩ আগস্ট পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনও গম আমদানি না হলেও বেসরকারিভাবে আমদানি হয়েছে ৪২ হাজার ৯৯০ টন গম। গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সরকারিভাবে ৫ লাখ ৪৬ হাজার ১২০ টন গম আমদানি হয়। একই সময়ে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি হয়েছে ৩৪ লাখ ৬৫ হাজার ৯৯০ টন গম।

এদিকে চলতি বছরে ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সরকারিভাবে ১ লাখ ৫০ হাজার টন গম সংগ্রহের কথা বলা হলেও মাত্র ২০ টন গম সংগ্রহ করতে পেরেছে খাদ্য অধিদফতর। গত বছর একই সময়ে ১ লাখ ৩ হাজার ২১২ টন গম সংগ্রহ করেছিল খাদ্য বিভাগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসে ৬৩ হাজার ৪০০ টন গম আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়।

খাদ্য বিভাগের হিসেবে বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী, জাহাজীকরণের আগে রাশিয়া ও ইউক্রেনের গম টনপ্রতি ৩৬২ দশমিক ৫০ ডলার, আমেরিকান গম ৩৪১ ডলার। যাবতীয় আমদানি খরচ মিলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রতি কেজি রাশিয়ান গম ৪০ টাকা ৭৩ পয়সা, ইউক্রেনের গম ৪০ টাকা ৫৪ পয়সা এবং আমেরিকান গমের দাম পড়ে ৪০ টাকা ৪০ পয়সা। চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া। বিশ্ব অর্থনীতিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে। হু হু করে বাড়তে থাকে বিভিন্ন পণ্যের দাম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেয়।

গত এক বছরের তুলনায় আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম কমেছে ১০ শতাংশের বেশি। গতবছরের আগস্টে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন অপরিশোধিত চিনি বিক্রি হয়েছে ৪৩৫ দশমিক ৬৩ ডলার দরে। যা চলতি বছরের আগস্টে বিক্রি হয়েছে ৩৮৮ দশমিক ৬৭ ডলার দরে। তবে সেপ্টেম্বরে দাম কিছুটা বেড়েছে চিনির। সেপ্টেম্বরে অপরিশোধিত প্রতি টন চিনি বিক্রি হয়েছে ৪০২ দশমিক ১২ ডলার দরে। দেশে বছরে চিনির চাহিদা ১৮ থেকে ২০ লাখ মেট্রিক টন। আখ থেকে স্থানীয় পর্যায়ে চিনি উৎপাদনের পরিমাণ মাত্র ৩০ হাজার মেট্রিক টন। চাহিদা পূরণে বছরে অপরিশোধিত চিনি আমদানির পরিমাণ ২০ থেকে ২২ লাখ মেট্রিক টন। চিনি উৎপাদনে অপরিশোধিত চিনি পরিশোধনকালে প্রসেস লস ৬ শতাংশ। অপরিশোধিত চিনি আমদানির ক্ষেত্রে সিডি ৩০০০, আরডি ৩০ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, এটি ৪ শতাংশসহ মোট শুল্কের পরিমাণ প্রায় ৬১ শতাংশ।

আন্তর্জাতিক বাজারে মসুর ডালের দামও কমছে। দেশে মসুর ডালের চাহিদা ৫ লাখ মেট্রিক টন। স্থানীয় পর্যায়ে মসুর ডালের উৎপাদনের পরিমাণ ২ লাখ ৫৮ হাজার মেট্রিক টন। বছরে ৩ লাখ টনের বেশি মসুর ডাল আমদানি করতে হয়। ভোজ্যতেলের চাহিদা ২০ লাখ মেট্রিক টন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের পরিমাণ ২ লাখ ৩ হাজার মেট্রিক টন। আমদানি করতে হয় ১৮ লাখ মেট্রিক টন।

টিসিবি রাজধানীর বাজারের ৩২ ধরনের খাদ্যপণ্যের দামের ওঠা-নামার হিসাব রাখে। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য মতে, গত এক মাসের ব্যবধানে বাজারে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে আদার দাম, যা ৬১ দশমিক ৫৪ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি কেজি আদা যেখানে গত মাসে ১২০ থেকে ১৪০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে, সেটা এখন ২০০ থেকে ২২০ টাকা। আদার সঙ্গে আছে রসুনের। আমদানি করা রসুনের চেয়ে দাম বেড়েছে দেশি রসুনের। প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যে থাকা দেশি রসুন এখন ৭০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

গত একমাসের ব্যবধানে প্যাকেটজাত গুঁড়া দুধের দাম কোম্পানিভেদে বেড়েছে প্রতি কেজি ২০ থেকে ৫০ টাকা। এ নিয়ে চলতি বছর চতুর্থ দফায় বেড়েছে গুঁড়া দুধের দাম। এ বছর মার্চ, জুন ও আগস্টে তিন দফা দাম বেড়েছিল এ নিত্যপণ্যের। এমন পরিস্থিতিতে টিসিবি বলছে, মাসের ব্যবধানে গুঁড়া দুধের দাম বেড়েছে ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ পর্যন্ত। তবে বছরের ব্যবধানে এ দাম ২৭ শতাংশ বেড়েছে।

ডিমের দাম চলতি মাসে আবার বাড়ছে। বড় বাজারে ফার্মের মুরগির বাদামি ডিমের দাম উঠেছে প্রতি হালি ৪৫ টাকা, যা খুচরা বাজার আর পাড়া-মহল্লার মুদিদোকান থেকে কিনতে লাগছে হালিতে ৪৭ থেকে ৫০ টাকা। কিছুদিন আগেও যা ৩৮ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে ছিল। এ হিসাবে পণ্যটির দাম মাত্র একমাসের ব্যবধানে বেড়েছে ২৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এছাড়া বাজারে সরু চাল, আটা, ময়দা, চিনি, আলু, লবঙ্গের দাম বেড়েছে গত মাসের তুলনায় বেড়েছে ২৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

সংবাদটি শেয়ার করুন