ঢাকা | মঙ্গলবার
২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ,
১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কালের বিবর্তনে দুর্গাপূজা

কালের বিবর্তনে দুর্গাপূজা

আবহমান বাংলার অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দূর্গোৎসব। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে ফিরে ফিরে আসে প্রতিবছরের শারদীয় পূজা উৎসব। দূর্গা হলো মায়ের প্রতীক। দুর্গতিনাশিনী। দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুভ মহালয়ার মাধ্যমে শুরু হয়। তারপরে প্রথমা, দ্বিতীয়া এভাবে পঞ্চমী পর্যন্ত মূর্তি, প্রতিমা তৈরি ও সাজানোর কাজসহ পূজারম্ভ পর্ব চলতে থাকে। আর পূজার মূল পর্ব শুরু হয় ষষ্ঠীর মাধ্যমে। পূজারম্ভের ধারাবাহিকতায় একে মহাষষ্ঠী বলা হয় দুর্গাপূজা কবে, কখন, কোথায় প্রথম শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। দুর্গার পুজো শুরুর যথার্থ নথি না পাওয়া গেলেও, বৈদিক সাহিত্যে দুর্গার পরিচয় আছে।

অনেকের মতে, সম্ভবত মোঘল আমল থেকেই ধনী পরিবারগুলিতে দুর্গা পুজো করা হত। ইতিহাস বলছে দেবীর পুজো সম্ভবত ১৫০০ শতকের শেষ দিকে প্রথম শুরু হয়। সম্ভবত দিনাজপুর-মালদার জমিদার স্বপ্নাদেশের পর প্রথম পারিবারিক দুর্গা পুজো শুরু করেছিলেন। তবে এই দুর্গার রূপ ছিল অন্যরকম। লোককথা মতে আদি দুর্গার চোখ গোলাকার ও উজ্জ্বল এবং দেবী সাদা বাঘ ও সবুজ সিংহের ওপর বিরাজ করেন।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, দুর্গাপূজার প্রথম প্রবর্তক কৃষ্ণ, দ্বিতীয়বার দুর্গাপূজা করেন স্বয়ং ব্রহ্মা আর তৃতীয়বার দুর্গাপূজার আয়োজন করেন মহাদেব। আবার দেবী ভাগবত পুরান থেকে জানা যায়, ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু ক্ষীরোধ সাগরের তীরে দুর্গার আরাধনা করে বর লাভে সফল হন। যদিও মূল বাল্মীকির রামায়ণে দুর্গাপূজার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণে দুর্গাপূজার অস্তিত্ব আছে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী কবি কৃত্তিবাস ওঝা সংস্কৃত রামায়ণ বাংলা করার সময় মূল রামায়ণের বাইরের তৎকালীন সমাজে প্রচলিত বাংলার সামাজিক রীতিনীতি ও লৌকিক জীবনের নানা অনুষঙ্গ, অনেক মিথ, গল্প বাংলা রামায়ণে তুলে ধরেন।

কৃত্তিবাস অনুদিত রামায়ণ পরিচিতি পায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ নামে, যা বাংলাভাষী হিন্দু সমাজে বেশ জনপ্রিয়। সেখানে তিনি কালিকাপুরাণের ঘটনা অনুসরণে ব্রহ্মার পরামর্শে রামের দুর্গাপূজা করার কথা উল্লেখ করেছেন। জানা যায় আর্য ঋষিরা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রতীক হিসাবে দেবী দুর্গার আশীর্বাদ লাভের জন্য আরাধনা করতেন। মার্কাণ্ডেয় পুরান মতে, চেদী রাজবংশের রাজা সুরাথা ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কলিঙ্গে দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে দুর্গাপূজার অস্তিত্ব পাওয়া যায়।

ঢাকেশ্বরী মন্দিরে একাদশ ও দ্বাদশ শতক থেকে কালীপূজার সঙ্গে দুর্গাপূজাও হতো। ইতিহাসবিদ দানীর মতে, প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে রমনায় কালীপূজার সঙ্গে দুর্গাপূজা হতো। ইতিহাসের অন্য তথ্যমতে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের শেষে দিনাজপুরের জমিদার দুর্গাপূজা সূচনা করেন। আবার কারও মতে, ষোড়শ শতকে রাজশাহী তাহেরপুর এলাকার রাজা কংসনারায়ণ প্রথম দুর্গাপূজা করেন। ১৫১০ সালে কুচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ কুচবিহারে দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। অনেকে মনে করেন, ১৬০৬ সালে নদীয়ার ভবনানন্দ মজুমদার দুর্গা পূজার প্রবর্তন করেন। আবার কেউ বলেন, ১৬১০ সালে কলকাতার সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার দুর্গার ছেলে মেয়েসহ সপরিবারে পূজা চালু করেন।

ঊড়িষ্যার রামেশ্বরপুরে একই স্থানে ৪০০ বছর ধরে সম্রাট আকবরের আমল থেকে দুর্গাপূজা হয়ে আসছে। কাসিমবাজারের রাজা হরিনাথ ১৮৩২ সালে বারোয়ারি পূজা কলকাতায় পরিচিত করান। পরে তাদের দেখাদেখি আস্তে আস্তে তা উচ্চবর্ণের হিন্দু বাঙালি জমিদারদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সম্ভবত সেই থেকে বারোয়ারী পূজা বা সার্বজনীন শুরু।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় ২২ হাজার বছর আগে ভারতে প্যালিওলিথিক জনগোষ্ঠী থেকে দেবী পূজার প্রচলন শুরু হয়েছিল। হরপ্পা ও মহেঞ্জদারো সভ্যতা তথা সিন্ধু সভ্যতায় এসে তা আরও গ্রহণযোগ্য, আধুনিক ও বিস্তৃত রূপ লাভ করে। ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। আর্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবতাদের। অনার্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবীদের। ভারতে মাতৃরূপে দেবী সংস্কৃতির ধারণা অতি প্রাচীন।
বর্তমানে দুর্গাপূজা ভারতের আসাম, বিহার, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপকভাবে উদযাপন করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় সবচেয়ে বড় সামাজিক, সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে পালিত হয়। বর্তমানে পূর্ব ভারতের কলকাতা, হুগলি, শিলিগুড়ি, কুচবিহার, লতাগুড়ি, বাহারাপুর, জলপাইগুড়ি , আসাম, বিহার, দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গোয়া, গুজরাট, পাঞ্জাব, কাশ্মীর, অন্ধ্র প্রদেশ, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, কেরালায় ঘটা করেপালন করা হয়। শারদীয় দুর্গোৎসব।

নেপাল ও ভুটানেও প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালন করা হয় দুর্গাপূজা। বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, বগুড়া, দিনাজপুর সহ অন্যান্য জেলায়ও ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে শারদীয় দুর্গাপূজা পালন করা হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, মরিশাস, ফিজি, টোবাকো, কুয়েত, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সাড়ম্বরে এই উৎসব পালন করে থাকে।

আমাদের দেশে দুর্গাপূজাকে শারদীয় পূজা, শারদোৎসব বলা হলেও ভারতের বিহার, আসাম, উড়িষ্যা, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব, কেরালা, হিমাচল প্রদেশ, মহীশুর, তামিলনাড়ু, অন্ধ্র প্রদেশে এ পূজাকে নবরাত্রি পূজা বলা হয়। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রাণের উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শরৎকালের এ মাতৃআরাধনায় জেগে ওঠে সমগ্র বাংলা। রং-রূপ আর বৈচিত্র্যের এত বিপুল সমারোহ পৃথিবীর অন্য কোনো উৎসবে আছে কিনা জানা নেই। আর এ উৎসবকে বরণ করে নিতে সারাটি বছর জুড়ে বাঙালির অপেক্ষার যেন শেষ নেই। অবশেষে মা আসেন মর্ত্যে। অশুভ শক্তির বিনাশ করে ফিরে যান দেবলোকে।

সংবাদটি শেয়ার করুন