ঢাকা | সোমবার
১৯শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শাস্তির আগেই জুয়াড়িদের দ্বারা পুঁজিবাজারের ক্ষতি

শাস্তির আগেই জুয়াড়িদের দ্বারা পুঁজিবাজারের ক্ষতি

জুয়াড়িদের শাস্তি দিতে দীর্ঘসূত্রিতাই পুঁজিবাজারের ক্ষতির কারণ বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম। গণমাধ্যমের উদ্দেশে তিনি বলেন, কারসাজির তথ্য পেলেই দ্রুত লিখে বিনিয়োগকারীদের সচেতন করুন।

গতকাল শনিবার রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার : বর্তমান ও ভবিষ্যৎ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তি‌নি এ কথা বলেন। বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ) ও ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্টস ফোরাম (সিএমজেএফ) যৌথভাবে এ বৈঠ‌কের আ‌য়োজন ক‌রে।

একজন জুয়াড়ি ধরার প্রসঙ্গে শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বলেন, আমরা তখনই একজন জুয়াড়ি ধরতে পারি, যখন স্টক এক্সচেঞ্জ তদন্ত রিপোর্ট দ্রুত দেয়। তারপর নিয়ম অনুসারে তথ্য প্রমাণ যাচাই-বাছাই করে শাস্তি দিতে ছয় মাস থেকে এক বছর সময় লেগে যায়। ততক্ষণে বিনিয়োগকারী ও পুঁজিবাজারের যা ক্ষতি করার তা করে ফেলে জুয়াড়িরা।

জুয়াড়িদের ধরতে গণমাধ্যমের সহায়তা চেয়ে শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বলেন, আমাদের (বিএসইসি) একার পক্ষে পুঁজিবাজারের অনিয়মকারীদের সবাইকে ধরা সম্ভব না। যার যার অবস্থান থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে। পুঁজিবাজার উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে। বিশেষ করে, যখনি আপনারা (গণমাধ্যম) কারসাজির কোনো তথ্য পান, তখন দ্রুত লিখে দেবেন। লেখার মাধ্যামে বিনিয়োগকারীদের সচেতন করবেন। লেখলে বিনিয়োগকারীরা তাদের (জুয়াড়ি) হাত থেকে রক্ষা পাবে। পুঁজিবাজারও ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবে।

নতুন প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত করার প্রসঙ্গে শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বলেন, দেশের লাভজনক বড় বড় কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। এবিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। যথেষ্ট অগ্রগতি আছে। আশা করছি, চলতি বছরের মধ্যে কিছু কোম্পানির আইপিও পুঁজিবাজারে আসতে শুরু করবে।

পুঁজিবাজারের যেকোনো বিষয়ে অর্থমন্ত্রণালয়, মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী সবসময় সচেতন জানিয়ে শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে পুঁজিবাজারের কোনো বিষয় নিয়ে এসএমএস করলে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেন। পরামর্শ দেন। সমস্যা হলে দ্রুত সমাধান করেন। পুঁজিবাজার নিয়ে বেশ ইতিবাচক মনোভাব। সুতরাং এ রকম একজন লিডার থাকার পর মার্কেট নিয়ে চিন্তা করার কোনো কিছু নেই। নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে আমরা গত ২ বছর ৩৬টি কোম্পানির আইপিও দিয়েছি। এই সময়ে ৩ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

আমাদের দেশে এখন যে অবস্থা এফডিআরের সুদহার ৭ শতাংশের কাছাকাছি হয়ে গেছে জানিয়ে শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বলেন, আমাদের লোনের যে রেট তা ৯ শতাংশের আশেপাশে। আমাদের ইনফুলুয়েশন ঋণ এখন ৬ শতাংশের আশেপাশে। এরকম অবস্থায় আমাদের দেখে নিতে হবে, আমরা যাদের সাথে তুলনা করছি, তাদের ইকোনমি আর আমাদের ইকোনোমি এক কিনা। আপনারা এখানে যারা আছেন সকলে দেশ প্রেমিক এবং সবাই ক্যাপিটাল মার্কেটকে ভালোবাসেন বলেই তুলনা করার আগেই একটু দেখে নিতে হবে। সমালোচনা অবশ্যই করবেন, তবে কার সাথে সমালোচনা করছেন সেটা অবশ্যই একটু দেখে নিবেন।

বৈঠকে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসেন বলেন, আমাদের পুঁজিবাজারে ২০ শতাংশের কম প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী। এই সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ইলিজিবল কোটা বাড়িয়েছি। কিন্তু বাড়ানোর পরেও এরা সাধারন বিনিয়োগকারীদের মতো আচরন করে। এখানে যাতে জবাবদিহিতা তৈরী হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে তাদেরকে আরও সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু লাভ হলেই একসঙ্গে সব বিক্রি করে দেওয়া হলেতো সেইভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী গড়ে উঠবে না।

আমাদের পুঁজিবাজারে অনেকগুলো দূর্বলতা আছে জানিয়ে খায়রুল হোসেন বলেন, সেগুলো আমাদের জন্য শক্তি। আমাদের জিডিপির তুলনায় বাজার মূলধন অনেক কম, শিল্পায়নে ব্যাংকের তুলনায় বাজার থেকে অর্থায়ন কম, ফরেন ইনভেস্টমেন্ট কম, পিই রেশিও কম, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের অংশগ্রহন কম। এগুলো নিয়ে কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। যাতে এইসব দূর্বলতা কিন্তু আমাদের জন্য শক্তিও।

ভালো কোম্পানির পুঁজিবাজারে না আসার পেছনে অনেকগুলো কারন আছে উল্লেখ করে খায়রুল হোসেন বলেন, উদ্যোক্তাদের মধ্যে পুঁজিবাজার নিয়ে সচেতনতা তৈরী করতে হবে। কারন এই বাজারে গেলে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে বলে তারা মনে করে। ঋণ করে পরিশোধ করতে হলেও এখানে তা করতে হয় না। পুঁজিবাজারে আসার পেছনে আরেকটি অন্যতম কারন হিসেবে রয়েছে ব্যাংক থেকে সহজেই দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন। এছাড়া তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে কর হার ব্যবধান বাড়ানো দরকার হলেও এবার তা কমানো হয়েছে। মূলধন সুরক্ষা প্রসঙ্গে খায়রুল হোসেন বলেন, নিজের ক্যাপিটালের সুরক্ষা বিনিয়োগকারীকেই দিতে হবে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীকে সুরক্ষায় সব আইনেই বলা হয়েছে। কিন্তু নিজের সুরক্ষা, নিজেকেই দিতে হবে।

পুঁজিবাজারে হতাশা এবং আশা, দুটো দিকই আছে জানিয়ে বাজার বিশ্লেষক অধ‍্যাপক আবু আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানি আনা দরকার হলেও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির সঙ্গে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার ব‍্যবধান কমিয়ে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এটা সরকার সঠিক পলিসি নেয়নি। দেশে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো কর দেয় বেশি। এজন্য প্রণোদনা দিয়ে ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে হবে।

১০ শতাংশ ব্যবধান ছিল, সেটা সাড়ে সাত শতাংশ করা হলো জানিয়ে আবু আহমেদ বলেন, আমরা যেখানে ১৫ শতাংশ (তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে) ব্যবধান চেয়েছি, কিন্তু সাড়ে সাত শতাংশ ব্যবধান করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মোট করের ৮০ শতাংশ আসে তালিকাভুক্ত কোম্পানি থেকে। সুতরাং এনবিআরের প্রচেষ্টা থাকা উচিত বেশি কোম্পানি পুঁজিবাজারে আনা। কোম্পানি কখন লিস্টিংয়ে আসবে? যখন তাদের লাভ হবে।

বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জে নেসলে-ইউনিলিভার আছে জানিয়ে আবু আহমেদ বলেন, আমার এখানে নেই কেন? ১৭ কোটি মানুষ, এ দেশের মানুষকে অজ্ঞ, মূর্খ মনে করে তারা? পাবলিক ইন্টারেস্টে কিনা করা যায়? মেটলাইফে লাইন ধরে মানুষ টাকা জমা দিচ্ছে। কিন্তু তারা লিস্টেট না। কেন? কেউ কি প্রশ্ন করেছেন।

কতোগুলো সিক ও জাঙ্ক কোম্পানি দিয়ে পুঁজিবাজারকে চালানো হচ্ছে জানিয়ে আবু আহমেদ বলেন, আপনারা দেখেন সাড়ে ৩শ মধ্যে কয়টা যোগ্য কোম্পানি। আমাদেরকে ফোকাস করতে হবে তাদেরকে (নেসলে, ইউনিলিভারের মতো কোম্পানি) আসতেই হবে। হয় ইনসেনটিভ দিয়ে, আমি মনে করি ইনসেনটিভ ভালো উপায়। ওরা অন্যখানে থাকলে এখানে থাকতে পারবেনা কেন?

আমরা তাদের সাবান ব্যবহার করি, পারফিউম ব্যবহার করি, নুডুল খাচ্ছি। বাহিরে তাদের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ শেয়ার পুঁজিবাজারে ছাড়তে হয়। আমাদের এখানে মাত্র ১০ শতাংশ ছাড়লেই হয়। তারা আমাদের দেশে ব্যবসা করে বিপুল মুনাফা নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ১০ শতাংশ মালিকানা বাংলাদেশকে দিতে চায় না। আইপিওতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ন‍্যায় বড় বিনিয়োগকারীদের কোটা সুবিধা দেওয়া দরকার বলে মনে করেন আবু আহমেদ।

সিএমজেএফের সভাপতি জিয়াউর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিএমবিএর সভাপতি মো. ছায়েদুর রহমান। মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএমবিএর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. মনিরুজ্জামান। অনুষ্ঠানে বক্তব্যে রাখেন পুঁজিবাজার স্থিতিশীল তহবিলের চেয়ারম্যান ও সাবেক মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান, বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মো. জাহিদ হাসান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (ইডি) ড. মো. এজাজুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলাল, হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আল-আমিন, ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড ডি রোজারিও, সিএফএ সোসাইটির প্রেসিডেন্ট শাহীন ইকবাল, ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্ট বাংলাদেশের (আইসিএমএবি) প্রেসিডেন্ট মামুনুর রশীদ, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট বাংলাদেশের (আইসিএবি) কাউন্সিল সদস্য গোপাল চন্দ্র ঘোষ।

আনন্দবাজার/কআ

সংবাদটি শেয়ার করুন