ঢাকা | সোমবার
১৯শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ,
৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের অনিশ্চিত গন্তব্য

ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের অনিশ্চিত গন্তব্য

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ব্রিটিশ রাজা জর্জ এবং রানি এলিজাবেথের প্রথম সন্তান। তার বাবা ১৯৩৬ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। সেই সময় থেকেই এলিজাবেথ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ছিলেন। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাবা রাজা জর্জ মারা গেলে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ সিংহাসনে বসেন এবং কমনওয়েলথের প্রধান হন। তার রাজ্যাভিষেক বিশ্বজুড়ে টিভি রেকর্ড গড়ে। এ ছাড়া রাজতন্ত্র ও ব্রিটিশ কমনওয়েলথের জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা করেন তিনি।

১৯৫৭ সালে আধুনিক সমাজে রাজতন্ত্রের ভূমিকা নিয়ে একটি বিতর্ক শুরু হয়। যে বিষয়টি নিয়ে বিস্ময় তৈরি হয়েছিল তা হলো ঐ বিতর্কের অবতারণা করেন লর্ড সভার কনজারভেটিভ পার্টির একজন সদস্য। লর্ড আলট্রিনচ্যাম- যিনি পরে লর্ড সভা থেকে বেরিয়ে যান এবং লর্ড পদবী বাদ দিয়ে বলেছিলে তিনি শুধু পরিচিত হবেন জন গ্রিগ নামে- ন্যাশনাল অ্যান্ড ইংলিশ রিভিউ নামে একটি বিশেষ ধরণের সাময়িকীতে একটি আর্টিকেল লেখেন।

ঐ আর্টিকেলে কম বয়সী রানি সম্পর্কে তিনি লেখেন- রানি হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার জন্য “তার প্রশিক্ষণে দারুণ ঘাটতি রয়েছে”। রানির কথা বলার ধরণের সমালোচনা করে লেখেন, শুনলে তার “ঘাড়ে ব্যথা” হয়। রানির ব্যক্তিত্বকে তিনি “একজন যথার্থ স্কুল ছাত্রীর” সাথে তুলনা করেন। লর্ড আলট্রিনচ্যাম লেখেন, রাজতন্ত্রকে “একই সময়ে সাধারণ এবং অসাধারণ হওয়ার প্রায় অসম্ভব” চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হবে। ঐ আর্টিকেল প্রকাশের পর যে বিতর্ক শুরু হয় তাতে বোঝা যায় রাজতন্ত্র যেভাবে চলছে তা নিয়ে ব্রিটিশ সমাজে নানারকম মতামত রয়েছে। সমালোচনার চাপে আলট্রিনচ্যাম তখন বলেছিলেন তার ঐ আর্টিকেলের উদ্দেশ্য ছিল “রাজতন্ত্রের স্বার্থ রক্ষা, একে শক্তিশালী করা যাতে প্রতিষ্ঠানটি টিকে থাকতে পারে। এই প্রতিষ্ঠান এতই মূল্যবান যে সেটিকে অবজ্ঞা করা যায় না। রাজপরিবারের সাথে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি “সত্যিকারের শ্রেণীহীন কমনওয়েলথ রাজপ্রাসাদের” কথা বলেন। প্রিন্স চার্লসের শিক্ষা নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

১৯৮১ সালে রানির বড় ছেলে প্রিন্স চার্লস এবং ডায়ানার বিয়ের বিষয়টিও মানুষের মধ্যে আলোচনার জন্ম দেয়। নব্বইয়ের দশকে প্রিন্সেস ডায়ানার প্রতি গণমাধ্যমের ব্যাপক মুগ্ধতা ছিল। ব্যাপক আলোচিত ওই দম্পতি ১৯৯২ সাল থেকে আলাদা থাকতে শুরু করেন এবং ১৯৯৬ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। ওই সময় রানি ক্রমে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যান। ১৯৯২ সালের একটি বক্তৃতায় রানি এই বছরটিকে তাঁর জীবনের ভয়ংকর বছর বলে উল্লেখ করেন।

রাজা তৃতীয় চার্লস এখন অস্ট্রেলিয়ারও রাজা এবং রাষ্ট্রপ্রধান। তার মায়ের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সাথে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সম্পর্কের এক নতুন পরিচ্ছেদের সূচনা হলো। প্রশ্ন হলো, এ সম্পর্ক ভবিষ্যতে কেমন থাকবে – বা আদৌ থাকবে কিনা। কারণ, রাজতন্ত্রের সাথে অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্ক মোটেও সহজ-সরল নয়, বরং বেশ জটিল। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু দেশটিতে রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্র ঘোষণার বিতর্ককে আবারো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে।

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল- একজন কট্টর রিপাবলিকান হলেও – টিভিতে প্রয়াত রানির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তার চোখে জল এসে গিয়েছিল। তবে মি. টার্নবুল স্পষ্ট করেই বলেছেন, অস্ট্রেলিয়াকে প্রজাতন্ত্রে পরিণত করার ওপর গণভোট হয়তো শিগগিরই হবে না – কিন্তু একদিন এটা হতেই হবে, এটা অবধারিত।

মাত্র কিছুকাল আগেই বারবাডোজ ব্রিটিশ রাজতন্ত্র এবং ঔপনিবেশিক শাসনের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তারা রানি এলিজাবেথকে তাদের রাষ্ট্রপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে পৃথিবীর নবতম প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়াও বহুকাল ধরেই প্রজাতন্ত্রে পরিণত হবার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে আসছেন ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মত আরো কিছু দেশের অনেকে। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ শুধু ব্রিটেনের রানিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন আরো ১৪টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান – যে দেশগুলোর সবই একসময় ছিল ব্রিটেনের উপনিবেশ। কিন্তু নতুন রাজা তৃতীয় চার্লসের রাজত্বকালের বাস্তবতা হয়তো হবে অন্য রকম।

বারবাডোজ প্রজাতন্ত্রে পরিণত হবার পর সংবাদমাধ্যমে বিশ্লেষকরা বলেছেন এটা এক “ডমিনো এফেক্ট” সৃষ্টি করতে পারে – অর্থাৎ অল্প কিছুকালের মধ্যেই হয়তো আরো অনেক দেশই ব্রিটেনের রাজাকে তাদের রাষ্ট্রপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দিতে পারে, বিশেষ করে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে। এমনকি খোদ ব্রিটেনেও এমন লোকের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে – যারা রাজতন্ত্রের বিলোপ চান, যুক্তরাজ্যকে একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত করতে চান।

রানির মৃত্যুর পর রাজা তৃতীয় চার্লস এখন ক্যারিবিয়ান দেশ জ্যামাইকারও রাজা এবং রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু জ্যামাইকাও এ বছরের শুরুতে সেদেশে প্রিন্স উইলিয়ামের সফরের সময় তার ভাষণে স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে তারা ঔপনিবেশিক অতীতের সাথে সম্পর্ক ছেদ করতে চায়, এবং বারবাডোজের মতই একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হতে চায়। সম্প্রতিক জরিপগুলোয় দেখা গেছে জ্যামাইকার ৫০ শতাংশ মানুষ এখন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে এবং রানি এলিজাবেথের মৃত্যু হয়তো এ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে। জ্যামাইকায় শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য কাজ করছে এমন একটি প্রতিষ্ঠান দি অ্যাডভোকেসি নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী অধ্যাপক রোজালিয়া হ্যামিলটন বলছেন, “এ নিয়ে কথাবার্তা আবার শুরু হয়েছে। আমরা যতই কথা বলবো, ততই আরো বেশি জ্যামাইকান জেগে উঠবে।”

শুরুতে অস্ট্রেলিয়াকে প্রজাতন্ত্র করার সমর্থকদের কথা ছিল। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিবেশী নিউজিল্যান্ডেও এমন ভাবনাচিন্তা বাড়ছে। রানির মৃত্যুর পর আবার জোরদার হয়েছে সেই আলোচনা। তবে সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন বলেছেন, তিনি মনে করেন তার জীবদ্দশাতেই নিউজিল্যান্ড একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হবে তবে তার দেশ এখনই এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে না। যুক্তরাজ্যে সবশেষ জনমত জরিপে দেখা যায়, ৬১ শতাংশ লোকই এখনো রাজতন্ত্র বহাল রাখার সমর্থক, অন্যদিকে ২৪ শতাংশ চান একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান। তবে ব্রিটেনের ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়স্কদের মধ্যে এ ব্যাপারে মত পরিবর্তন হচ্ছে বলে দেখা গেছে গত কয়েক বছরে। এই বয়সের নাগরিকদের ওপর চালানো এক জরিপে ২০১৯ সালে দেখা যায়, ৪৬ শতাংশ ব্রিটেনে একজন রাজা বা রানি থাকার পক্ষে, অন্যদিকে ৩১ শতাংশ চান নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু একই বয়সীদের ওপর ২০২১ সালে চালানো জরিপে দেখা যায়, রাজতন্ত্র সমর্থন করেন মাত্র ৩১ শতাংশ এবং ৪১ শতাংশ চান ভোট দিয়ে একজন রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত করতে।

এবছরের শুরুর দিকে রানির সিংহাসনে ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠানমালার সময় রিপাবলিক নামে একটি রাজতন্ত্রবিরোধী সংগঠন যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে বিলবোর্ড লাগিয়ে দেয়। এতে শ্লোগান ছিল “মেক এলিজাবেথ দ্য লাস্ট” – বা ‘এলিজাবেথকে শেষ রানিতে পরিণত করুন।’ এর তীব্র সমালোচনা হয়, তবে রিপাবলিকের প্রধান নির্বাহী গ্রাহাম স্মিথ বলেন, “৭০ বছর এক ব্যক্তির রাষ্ট্রপ্রধান থাকা গণতন্ত্রের জন্য কোন স্বাস্থ্যকর ব্যাপার নয়,” এবং তার মতে ব্রিটেনের রাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়া উচিত।

সংবাদটি শেয়ার করুন